করোনাকালে বেড়েছে বন্য প্রাণী হত্যা

করোনা মহামারির সময় লকডাউনসহ নানা কারণে প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমছে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশের জীববৈচিত্র্যে নতুন প্রাণ ফিরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্রও দেখা যাচ্ছে। করোনার এ সময়ে দেশে বন্য প্রাণী হত্যা তুলনামূলক বেড়েছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শনিবার বিশ্বজুড়ে পালন করা হচ্ছে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘টিকে থাকতে প্রকৃতির অপরিহার্যতা’।

বন বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে গত ১৪ মাসে তিনটি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। ডাঙার সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতি হত্যার ক্ষেত্রেও গত এক বছরে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। পানির সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমির মৃত্যুর ক্ষেত্রে করোনার বছরটি সবচেয়ে ভয়াবহ বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচারও তুলনামূলক বেড়েছে এ সময়ে। করোনাকালে বিপন্ন হয়েছে দেশের পাহাড়গুলোও।

বন বিভাগ এবং বন্য প্রাণীবিষয়ক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় প্রাণী বাঘ হত্যা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত করোনার এ সময়ে বেঙ্গল টাইগার মারা গেছে দুটি। এর বাইরে গত বছর দুটি বাঘ ফাঁদে আটকা পড়ে আহত অবস্থায় মারা যায়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাগেরহাটে একটি বাঘের চামড়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ একজন পাচারকারীকে আটক করে বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অর্থাৎ গত ১৪ মাসে হত্যার শিকার হয়েছে তিনটি বাঘ।

আয়েশে বসে হাই তুলছে বাঘ
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সংসদে সরকারি দলের একজন সাংসদের দেওয়া প্রশ্নের জবাবে গত সেপ্টেম্বরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেছেন, গত ২৪ বছরে মোট ২৪টি বাঘকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর ১০টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে একটি করে বাঘ হত্যার শিকার হচ্ছে।

বন বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএনের তথ্যমতে, গত এক বছরে দেশে মোট ১২টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। বেশির ভাগ হাতিকে হত্যা করা হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে ও গুলি করে। অথচ ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে গড়ে বছরে চার থেকে পাঁচটি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চাকফিরানী গ্রামের পাহাড়ি এলাকা দক্ষিণের ঘোনায় উদ্ধার হওয়া মৃত হাতি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে কক্সবাজারের টেকনাফের সংরক্ষিত বনের এক পাশে ৪৪টি হাতি আটকে আছে। শিবিরগুলো এশীয় বন্য হাতির চলাচলের প্রধান পথে পড়েছে। ফলে আটকে পড়া হাতিগুলো ঘুরপথে মানুষের বসতি এলাকার দিকে যাচ্ছে। খাদ্যসংকটে পড়ায় তারা মানুষের ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ছে। মানুষ ফসল ও বসতভিটা রক্ষায় হাতি হত্যা করছে।

এ ব্যাপারে আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতর দিয়ে হাতির যাওয়ার একটি করিডর তৈরির পাশাপাশি দেশে হাতির বিচরণের অন্য পথগুলো সুরক্ষিত করতে হবে। নয়তো দেশে টিকে থাকা ২৬৩টি হাতি আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে।

কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে ভেসে আসা মৃত তিমি
ফাইল ছবি প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, দেশের উপকূলে করোনার আগের ১৪ বছরে ১০টি তিমির মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে। সেখানে গত এক বছরে উপকূলে ভেসে এসেছে চারটি তিমির মৃতদেহ।

বন্য প্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশের হিসাব বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশে ২০টি ডলফিন মারা গেছে। অথচ ২০১৯ সালে ১০টি, ২০১৮ সালে ১৪টি ও ২০১৭ সালে চারটি ডলফিন মারা গেছে। এ হিসাব অবশ্য যেসব ডলফিনের মৃতদেহ সাগরের সৈকতে ও নদীর তীরে ভেসে এসেছে, তার সংখ্যার ভিত্তিতে দাঁড় করানো হয়েছে।

দেশের বন্য প্রাণী হত্যা, পাচারসহ এ বিষয়ে অপরাধ দমনে বন বিভাগের একটি বন্য প্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট আছে। সেখানকার হিসাবেও করোনাকালে দেশের অন্যান্য বন্য প্রাণী যেমন পাখি, বনরুই, গন্ধগোকুল, তক্ষক, বনবিড়ালসহ নানা প্রজাতির প্রাণী হত্যা ও পাচারের শিকার হয়েছে।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে ভেসে এসেছে মৃত ডলফিন
প্রথম আলো ফাইল ছবি

এ ব্যাপারে বন বিভাগের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই করোনার মধ্যেও যেখানে বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচারের খোঁজ পেয়েছি, সেখানেই ছুটে গেছি। অন্য বছরগুলোর মতো এ বছরও আমরা বন্য প্রাণী রক্ষায় কাজ করেছি।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জানানো হয়েছে, দেশের ১ লাখ ৬০ হাজার জন প্রভাবশালীর হাতে ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি দখল হয়ে আছে। আবার গত কয়েক মাসে বন বিভাগ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫৭ একর বনভূমি দখলমুক্ত করা হয়েছে।

তবে করোনাকালে বনের চেয়ে বেশি বিপন্ন হয়েছে দেশের পাহাড়গুলো। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে নির্বিচার পাহাড় কাটা হয়েছে।

পাহাড় কাটা থামাতে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি অভিযানও চালানো হয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে একটি চিঠি লিখেন।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বাবুছড়া নোয়াপাড়া এলাকায় খননযন্ত্র দিয়ে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটা হচ্ছে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ওই চিঠিতে মোয়াজ্জেম হোসাইন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাহাড় কাটার কথা উল্লেখ করে বলেন, শুধু কক্সবাজারের চুনতি বনভূমি এলাকায় ১৫ থেকে ২০টি পাহাড় থেকে ২ কোটি ঘনফুট মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে। ওই মাটি দিয়ে রেল প্রকল্পের জন্য ভূমি ভরাট করা হয়েছে, রাস্তা বানানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ে অবৈধ ৩২০ জন দখলদারকে উচ্ছেদ করার কথাও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দেশের জ্যেষ্ঠ বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বে এ পর্যন্ত যতগুলো মহামারি হয়েছে, তার বেশির ভাগই বন্য প্রাণী থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। বন্য প্রাণীর বসতিগুলো ধ্বংস হওয়ায় তাদের সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ আরও বেড়েছে। কিন্তু করোনার সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরও আমরা দেখতে পেলাম, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস বেড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে হয়তো আরও বড় বিপর্যয় আসতে পারে।’