কানাইবাঁশির নীল রঙে

নীল রঙের কানাইবাঁশি ফুল, বরিশালের কীর্তনখোলার তীর থেকে
ছবি: লেখক

‘... ...ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;/

চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি—শাদা শাঁখা—বাংলার ঘাস/ আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ—আপনার মনে/ ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;—চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস’—

জীবনানন্দ দাশ

দুপুরের আকাশ ভরে গেছে নীলে। দূরের প্রান্তরে চেয়ে দেখি কেবল চর, সবুজ ধানখেত ও ঘাস। পাকরা শালিকের দল ছোটাছুটি করছে নদীর কিনারে। মাছরাঙা অসীম ধৈর্য নিয়ে বসে আছে শেওড়ার ডালে, মাছের জন্য। জোয়ারের জলে কচুরিপানার ছোট ছোট দঙ্গল ভেসে আসছে নদীর দক্ষিণ দিক থেকে। কচুরির সেই ছোপে বসে আছে কানিবক। ছোট ছোট মাছ ও জলজ পোকা তার খাবার। জলে ভাসা কচুরিপানার ঝোপের নিচে মাছের পোনা ও চিংড়ি আশ্রয় নেয়। বক তাদের জন্যই কচুরির ঝোপে যায়। জোয়ারের জলে এক নদী থেকে আরেক নদীতে কখন সে চলে যায় মাছের নেশায়, সে হয়তো টের পায় না। হয়তো ভাটার সময় সে ফিরে আসবে তার নীড়ে। পড়ন্ত বিকেল আসে। নদীর জল স্থির হয়। সূর্যের আলোয় নদীর জলের রুপালি ঝিলিক আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আকাশের নীল রং ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু মায়াবী এক বুনো ফুলের নীল রং জেগে থাকে। একসময় সন্ধ্যা নামে। নৌকায় হারিকেন ও কুপির আলো জ্বলে ওঠে।

সেদিনের সেই মায়াবী নদীর তীরে হেঁটে চলা পথে আমাকে অভিভূত করেছিল এসব দৃশ্য এবং এক বন ফুলের নীল রং। সবুজ পাতার সঙ্গে সজীব ও গাঢ় নীল ফুলের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণ। ফুলের গঠন দেখতে কোন নারীর কানে পরা অলংকারের মতো। লোকে তাই নাম দিয়েছে কানদুলি, কানছিঁড়া, কানাইবাঁশি। বাংলাদেশের পথে–প্রান্তরে, জলাশয়ের কিনারে, সমতলে, ধানখেতের আইলে, পাহাড়ে সাত প্রজাতির কানাইবাঁশি দেখা যায়। ফুলের গঠনশৈলী দেখতে প্রায় একই রকম। তবে প্রজাতিগুলোর পাতা ও ফুলের সাইজের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি প্রজাতি ঢোল পাতা নামেও পরিচিত। পাতার আকৃতি ঢোলের মতো, তাই এ নাম। কয়েকটি প্রজাতি সহজলভ্য যেমন কমেলিনা বেঙ্গেলেনসিস, কমেলিনা ডিফুজা এবং কমেলিনা ইরেকটা। প্রতিটি প্রজাতির ফুলে রং নীল এবং প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে।

দেশে এত এত বনফুলের প্রজাতি রয়েছে, যা দিয়ে আমরা সাজাতে পারি আমাদের বাড়ির অঙ্গন, বারান্দার টব, পথের দুপাশ। কানাইবাঁশির প্রতিটি প্রজাতিই শোভাবর্ধনকারী ফুল হিসেবে মানানসই। এরা মাটিতে বেয়ে বেয়ে বেড়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একটি ধূসর মাঠকে সবুজে পরিণত করে।

কানাইবাঁশি বর্ষজীবী বীরুৎ। শাখা–প্রশাখা বিস্তৃত। কাণ্ডে পর্ব ও মধ্যপর্ব থাকে। প্রজাতিভেদে লম্বার তারতম্য রয়েছে তবে ৪০ সেন্টিমিটার বা ততোধিক হতে পারে। অনেকে কয়েকটি প্রজাতির পাতা ও কচি কাণ্ড সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। প্রজাতিগুলোর পাতায় অ্যান্টিসেপটিক গুণ রয়েছে, যা ক্ষত নিরাময়ে কাজ করে। চীনে ফুল থেকে প্রাপ্ত রং চিত্রকর্ম আঁকতে ব্যবহার করা হয়। এ ফুলের সাধারণ ইংরেজি নাম ডে ফ্লাওয়ার।