গুণে অনন্য বামনহাটি

টাঙ্গাইলের মধুপুরের বনে বামনহাটি। সম্প্রতি তোলাছবি: লেখক

বামনহাটি দেখেছি অনেক বছর আগে, ছেলেবেলায়। কিন্তু নাম জেনেছি অনেক বছর পর। বাড়ির সীমানা ঘেঁষে বুনো ঝোপঝাড়ের ভেতর ছিল গাছগুলো। মনে পড়ে, বছরে অন্তত একবার সাপ–জোঁকের ভয়ে এসব আগাছা পরিষ্কার করানো হতো। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই বুনো উদ্ভিদগুলো আবার নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিত। বামনহাটি জন্মাতো ঢালের দিকে। ওপরের দিকটায় দেখা যেত গো-রসুন বা বনলিলির ঝাড়। বামনহাটির ফুলগুলো কেমন যেন নেতিয়ে থাকত। কিন্তু গো-রসুনের ফুল দেখতে বেশ নান্দনিক ও সুগন্ধি ছিল। ফলে বনলিলির প্রতি আমাদের খানিকটা পক্ষপাত ছিল। বাড়িতে এখন দুই উদ্ভিদের কোনোটি নেই। তারপর দেশের বিভিন্ন স্থানে বামনহাটির সঙ্গে আরও কতবার যে দেখা হয়েছে, তার হিসাব নেই। সবশেষে দেখেছি মধুপুরের বনে।

বামনহাটি বা বনচাট ফাঁপা কাণ্ডবিশিষ্ট বহুবর্ষজীবী গুল্মশ্রেণির শাখা-প্রশাখা যুক্ত উদ্ভিদ। সাধারণত ৩ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১ থেকে আড়াই সেন্টিমিটার প্রশস্ত পাতাগুলো ঘূর্ণিযুক্ত, বোঁটাহীন, প্রতিটি ঘূর্ণিতে ৩ থেকে ৫টি পাতা থাকে। ফুল সাদা, ডালের আগায় প্রায় দেড় সেন্টিমিটারজুড়ে বিস্তৃত পরিসরে ফোটে। নতুন ফুল লালচে রেখাযুক্ত, নলাকার, সাধারণত ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ও রোমহীন। পাপড়ি ডিম্ব-আয়তাকার, ১ থেকে দেড় সেন্টিমিটার লম্বা ও ভোঁতা। মঞ্জরিদণ্ড থেকে পর্যায়ক্রমে ফোটা ফুলগুলো ঝুলে থাকে। রক্ত-বেগুনি রঙের ফুলগুলো পরে নীলাভ বেগুনি রঙে পরিণত হয়। ফলের চারপাশ দীর্ঘায়িত বৃতিতে আংশিক আবৃত থাকে। বামনহাটি দেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, রংপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ফুল ফোটার মৌসুম জুলাই থেকে অক্টোবর।

বামনহাটির (Clerodendrum indicum) ভেষজ গুণ অসাধারণ। এ গাছে অ্যালকালয়েড থাকায় এর স্বাদ তেতো ধরনের। এশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে আফিমের পরিবর্তে এই গাছের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। মূলের ছালে ফেনোলিক গ্লাইকোসাইড এবং সেপোনিনের উপাদান সক্রিয় থাকায় শরীরের রক্ত সঞ্চালন ও পরিপাক ক্রিয়াকলাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এটি শ্বাসযন্ত্রের স্বাভাবিকতা বজায় রাখে বলেই কাশি, সর্দি এবং হাঁপানি উপসর্গ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, গাছের মূল বেটে অল্প চিনি মিশিয়ে শরবত করে সকালে খালি পেটে খেলে মূর্ছা রোগের উপকার হয়। ফুল ও পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগালে দ্রুত সেরে যায়। মূল ও পাতা বেটে বড়ি তৈরি করে শুকিয়ে খেলে কৃমি ভালো হয়। তা ছাড়া এক থেকে দেড় গ্রাম মূলের ছাল টুকরো করে তার সঙ্গে অল্প পরিমাণ আদা মিশিয়ে বেটে গরম পানিসহ প্রতিদিন সকাল–বিকেল খেলে হাঁপানির কষ্ট দূর হবে। মূলের ছাল ও পাতা সমপরিমাণে বেটে বড়ি তৈরি করে দিনে এক থেকে দুবার খেলে কৃমি সেরে যাবে। এ ছাড়া বুকের ব্যথা ও শরীরের দাগ নিরাময়ে বামনহাটির মূলের ছাল ও ফুলের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।