ঘরে থাকলেও দূষণ থেকে নিস্তার নেই

ধুলায় আচ্ছন্ন চারদিক। এর মধ্য দিয়েই চলতে হচ্ছে সবাইকে। গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকায়।ছবি: হাসান রাজা

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা সায়মা ইসলামের চার বছরের সন্তানের ঠান্ডা-সর্দি ও অ্যালার্জি লেগেই থাকে। সন্তানকে নিয়ে তিনি বহুবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। চিকিৎসক ধুলাবালু এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।

সায়মা ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে সন্তানকে নিয়ে ঘর থেকে বের হননি বলেই চলে। তারপরও অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ঠান্ডা-সর্দিও নয়।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অভিভাবকেরা যত শিশুকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের ৪৯ শতাংশ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। ওই সময়ে রাজধানীর বাতাসে ধুলা ও দূষণ বেড়ে যায়, আর বর্ষা মৌসুমে শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুদের হার ৩৫ শতাংশে নেমে আসে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাতাসে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পারদ, সিসা, ক্যাডমিয়াম, নিকেলসহ নানা ধরনের ভারী বস্তুকণা ভাসছে। এসব ধুলা ঘরেও প্রবেশ করছে। ফলে বাসায় থেকেও শিশুরা রক্ষা পাচ্ছে না। আক্রান্ত হচ্ছে পরিবারের সবাই। সূক্ষ্ম বস্তুকণাগুলো ভেসে ভেসে ১০০ থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত উঁচুতে উঠছে। বাতাসের সঙ্গে তা ঘরে ঢুকছে।

বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পরিমাপে বাতাসে ভারী বস্তুকণার দূষণের দিক দিয়ে ঢাকা শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। প্রায়ই এক নম্বরে থাকে। রাজধানীর সব এলাকা ধুলাদূষণে আক্রান্ত। তবে যেসব এলাকায় উন্নয়নকাজ বেশি এবং রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, সেখানে ধুলা বেশি। যেমন বেগম রোকেয়া সরণির তালতলা থেকে মিরপুর ১২ নম্বর পর্যন্ত রাস্তায় ধুলার যন্ত্রণায় চলাচল করাই দায়। এই এলাকায় মেট্রোরেলের কাজ চলছে। সঙ্গে রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা হওয়ায় যানবাহন চললেই বাতাসে ধুলা ওড়ে।

বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীর শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে এই শহরের বাসিন্দারা একটি অসুস্থ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।
শফিউর রহমান, নিপসমের পেশাগত এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালামের নেতৃত্বে একদল গবেষক নিয়মিত বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁদের হিসাবে, ঢাকার বাতাসে যেসব ভাসমান বস্তুকণা ভেসে বেড়ায়, তার ৭০ শতাংশই ধুলা। অন্যদিকে বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গত মাসের এক জরিপ বলছে, ঢাকার বাতাসে ধুলার পরিমাণ ২০২০ সালের শীত মৌসুমের তুলনায় এবার ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টন ধুলা উড়ে বেড়ায় বলে ওই জরিপে উঠে আসে।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ধুলাদূষণ রোধে শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। পানি ছিটানো, সড়কে ঝাড়ু দেওয়া এবং নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না করায় দূষণ বেড়েছে।’

ঢাকার বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ, সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, মেরামতসহ অন্যান্য কাজে তৈরি হওয়া ধুলা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ থাকলেও তা খরচ করা হয় সামান্য। মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে পানি ছিটানো হয়। ধুলাবালু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয় না। দুই সিটি করপোরেশন রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়া ও পানি ছিটানোর কাজও ঠিকমতো করে না।

আমরা ধুলাদূষণ রোধে শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। পানি ছিটানো, সড়কে ঝাড়ু দেওয়া এবং নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না করায় দূষণ বেড়েছে।
অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন উল্লাহ নুরী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকায় ধুলা বেড়ে গেছে, এটার সঙ্গে আমি একমত। আজ সদরঘাট এলাকায় দেখলাম, কে বা কারা রাস্তার মধ্যে বালু ফেলে রেখেছে। সেগুলো ধুলা হয়ে উড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন দুই বেলা করে পানি ছিটাচ্ছি। তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছেন। এগুলো আরও বাড়াতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ, সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নরওয়ের বায়ুর মান গবেষণা কেন্দ্রের গত বছরের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, সূক্ষ্ম বস্তুকণাগুলো বাতাসে ভেসে ভেসে এক দেশ থেকে আরেক দেশেও চলে যায়। রাজধানীর বাতাসে যেসব সূক্ষ্ম বস্তুকণা রয়েছে, তার ৩০ শতাংশ চীন, ভারত ও নেপাল থেকে ভেসে আসে। এরপর এগুলো স্থানীয় ধুলা ও দূষিত বায়ুর সঙ্গে মিশে যায়। সব মিলিয়ে রাজধানীর বাতাসকে মারাত্মক দূষণের মধ্যে ঠেলে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের শীর্ষ তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহর ঢাকা, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই, লাহোর ও কাবুলের নাম উঠে আসছে। ফলে বায়ুদূষণ রোধে আঞ্চলিক সহযোগিতা দরকার। তার আগে নিজেদের ধুলাবালু নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, একসময় চীন ও ইন্দোনেশিয়ার বড় শহরগুলো ছিল সবচেয়ে দূষিত। সেখানে নানা উদ্যোগ নেওয়ায় বায়ুদূষণ বেশ কমেছে।

সরকারি সংস্থাগুলোর কার্যকর উদ্যোগ না থাকার মাশুল বেশি দিচ্ছে রাজধানীর শিশুরা। নিশ্বাসের সঙ্গে যাওয়া দূষিত বায়ু আর ধুলার মধ্যে নিত্যদিন বসবাসের কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, শুধু শ্বাসকষ্ট নয়, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের প্রদাহ, উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগ বায়ুদূষণের কারণে বাড়ছে। শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে বায়ুদূষণ।

নিপসমের পেশাগত এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান শফিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীর শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে এই শহরের বাসিন্দারা একটি অসুস্থ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।’