চোখ গেলর পালক ছাতারে

চোখ গেলর ছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে বনছাতারে। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুরে।
ছবি: লেখক

‘চোখ গ্যালো চোখ গ্যালো কেন ডাকিস রে/ চোখ গ্যালো পাখি রে। তোর চোখে কাহারো চোখ পড়েছে না কি রে/ চোখ গ্যালো পাখি রে।’

কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত গানের অংশবিশেষ। চোখ গেল পাখি এমন স্বরে ডাকে যে অনেক দূর থেকেও আলাদা করে তার সুর চেনা যায়। এটি মূলত এক প্রজাতির কোকিল। আমাদের বনে–বাদাড়ে প্রায় ২০ প্রজাতির কোকিল বাস করে। তাদের কোনোটি আবাসিক এবং কোনোটি পরিযায়ী। পৃথিবীর কয়েক প্রজাতির কোকিল বাদে বেশির ভাগ প্রজাতির কোকিল অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং বংশবিস্তার ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে। কোকিলের এই বৈশিষ্ট্যকে ইংরেজিতে বলা হয় ব্রুড প্যারাসিটিজম। কোকিলের বংশবিস্তারের জন্য অন্য প্রজাতির পাখির ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। সুইডেনের পাখিবিজ্ঞানীরা এখনো কাজ করছেন। বাংলাদেশেও কয়েকটি ভালো গবেষণা হয়েছে।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুর উপজেলায় হেলেঞ্চা নামে একটি শালবন আছে। রাকিন জহির নামের আমার এক ছাত্রসহ গত মে মাসের মাঝামাঝি গেলাম পাখি দেখতে সেই বনে। বিশেষত আমাদের কাঙ্ক্ষিত পাখি ছিল বনসুন্দরী বা দেশি শুমচা। এপ্রিল-মে মাসে শালবনে এবং বনের আশপাশের গ্রামে বনসুন্দরী দেখতে পাওয়া যায়। মূলত এরা পরিযায়ী হয়ে আসে গ্রীষ্মকালে, বাসা বাঁধে বনের গাছে। আমরা বনসুন্দরী পাখি শালবনে পেয়েছিলাম।

সেদিন শালবনে ঢুকেই দৃষ্টি পড়ল একটি চোখ গেল পাখির ছানার দিকে। পালকের বৃদ্ধি ও রং প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মতোই হয়েছে। ছানাটিকে কোন প্রজাতির পাখি লালন-পালন করছে, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ইতিমধ্যে সাত ভাই বা বনছাতারে পাখি খাবার নিয়ে উড়ে এল এবং কোকিল ছানাটিকে খাবার খাওয়াল। পরম যত্নেœএক জোড়া ছাতারে তাকে পালা করে খাবার খাওয়াচ্ছে। বনছাতারে তাদের ছানা মনে করেই কোকিল ছানাকে লালন-পালন করে। বৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে এখন শালবনে খাবারের প্রাপ্যতা ঢের। আমাদের দেশে চোখ গেল কোকিলরা ডিম পাড়ার জন্য পাতি টুনটুনি ও বনছাতারে পাখির বাসা ব্যবহার করে। তবে ডিম পাড়ার জন্য তাদের অনেক কসরত করতে হয়। ডিমের রংটা আবার সেই পোষক পাখির ডিমের রঙের মতোই হতে হয়। কোকিলরা এ কৌশল অর্জন করে নিয়েছে। পোষক পাখির ডিমের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ডিম পাড়ার বিষয়টি নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও নরওয়ের গবেষকেরা কাজ করেছেন।

অন্য পাখির ছানা পোষার এ বৈশিষ্ট্য আমাদের গ্রামের পোষা হাঁস-মুরগির মধ্যেও দেখা যায়। এখনো দেখা যায়, ডিম তা দেওয়ার সময় হলে অনেক সময় মুরগিকে দেওয়া হয় হাঁসের ডিম কিংবা হাঁসকে দেওয়া হয় মুরগির ডিম। ছানা ফুটলে হাঁস ও মুরগি ছানাদের যত্নœকরে। তবে তারা মুখ দিয়ে সরাসরি খাবার খাওয়াতে পারে না। সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, খাবার খুঁজে দেয়।

প্রকৃতিতে কত বিচিত্র বাস্তবতাই আছে। চোখ গেল কত সুন্দর পাখি। অথচ এদের মাতৃত্ব কিংবা পিতৃত্বের কোনো দায়িত্ব নেই। অন্য কোনো পাখি তাদের পালক মা-বাবা। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে টিকে আছে চোখ গেল পাখি।

তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর