ছোট চিত্রা ইগল

গাজীপুর থেকে ছোট চিত্রা ইগলের এই ছবি তুলেছেন আ ন ম আমিনুর রহমান
গাজীপুর থেকে ছোট চিত্রা ইগলের এই ছবি তুলেছেন আ ন ম আমিনুর রহমান

বলতে গেলে দিনভরই বৃষ্টি হয়েছে। শেষ বিকেলে আকাশভরা ঘন-কালো মেঘের জন্য যেন সন্ধের অন্ধকার নেমে গেছে। বাদুড়েরা বেরিয়ে পড়েছে খাবারের সন্ধানে। আমড়াগাছটার ডালে বসে কাঁচা আমড়া চিবোচ্ছে তিন-চারটি গেছো ইঁদুর।
হঠাৎই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যেন জঙ্গি বিমানের কায়দায় উড়ে গেল এক পাখি। আছড়ে পড়ল গিয়ে আমড়ার ডালে, বিমান-পাখিটি শাঁ করে মাটিতে নেমে লম্বা একখানা পা বাড়িয়েই ধরে ফেলল একটি ইঁদুরের লেজ। ঝটকা টানে বাইরে এনেই চালাল ঠোঁট। ইঁদুরের কান্না, লম্বা লেজের ডগাটা নখরে ঝুলিয়ে উড়াল দিল পাখিটি, বসল গিয়ে অনতিদূরের নারকেলগাছটির পাতার ওপর।
ঘটনাটি জুলাই মাসের ২৩ তারিখের। আমি নিজ গ্রামের বাড়িতে বসে দেখলাম।
পাখিটিকে বিরল বলে ধরা হয়। আমি কিন্তু প্রতিবছর জুলাই-আগস্টে বাড়ি (বাগেরহাট) গিয়ে পাখিটিকে দেখি। ডাকাত স্বভাবের পাখি। কাঠবিড়ালির বাসা ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছানা বের করে খায়। অন্য শিকারি পাখিদের থোড়াই কেয়ার করে। দুঃসাহসী, তবে বাজ বা দস্যুবাজের মতো এরা জলাভূমিতে তেমন থাকে না, অন্য পাখিদের ধাওয়াও সহজে করে না। এই দুই ভাইয়ের আকার-গড়ন-ধরন-রং ইত্যাদির ভেতর এতটাই মিল যে মনে হয় যমজ ভাই, হাতে ধরেও বোঝা দুঃসাধ্য—এটি কি দারোগাবাজ নাকি তার ছোট ভাই (Indian Spotted Eagle)।
একনজরে কালচে-বাদামি পাখি। ডানার উপরিভাগে কালচে-বাদামি ছোট ছোট ছিট-ছোপ। ঋতুভেদে রং বদলায়। তখন হতে পারে ঘন চকলেট-বাদামি রং। পা হলুদাভ। পায়ের পাতা ঘোলাটে-হলুদ। নখর কালো। লেজের আগা সাদা। ঠোঁট অপেক্ষাকৃত ছোট। আমাদের আবাসিক এই পাখিটির ভেতর কেমন যেন একটা ‘বাউল বাউল’ ভাব আছে, বাউন্ডুলে স্বভাব এদের। শরীরের তলদেশ ও পায়ের পালক ফিকে-বাদামি, চোখ হলুদাভ-বাদামি বা গাঢ়, ঠোঁটের কিনারা হলুদ।
বিপদাপন্ন এই শিকারি পাখিটির চারণক্ষেত্র বন-বাগান-খোলা মাঠ-উঁচু ভূমি। বৈজ্ঞানিক নাম aquila pomarina. দৈর্ঘ্য ৬০-৬৫ সেন্টিমিটার। বাংলা নাম ছোট চিত্রা ইগল বা গুটি ইগল।
মূল খাদ্য এদের ছোট ও মাঝারি পাখি, গেছো ইঁদুর, ধেনো ইঁদুর, বেঁশো ইঁদুর, গিরগিটি, ব্যাঙ-হাঁস-মুরগির ছানা ও নির্বিষ ছোট সাপ, কাঁকড়া ইত্যাদি। পাখি শিকার করে এরা গেরিলা কৌশলে। বেছে নেয় দুর্বল, আহত বা আনাড়ি পাখিদের। কণ্ঠ তীক্ষ্ণ সুরেলা, মনে হয় আশপাশের সবাইকে ধমক দিচ্ছে।
বড় বড় গাছের মগডালে সরু ডালপালা-পাটকাঠি-কঞ্চি-বাঁশের চটা-নারকেলের ছোবড়া ইত্যাদি দিয়ে বড়সড় ডালার মতো বাসা বানায়। পুরুষটি উপকরণ আনে, মেয়েটি বাসা বানায় ও মনমতো সাজায়। ডিম পাড়ে ১টি। ক্বচিৎ ২-৩টি। মেয়েটি একাই তা দেয় ডিমে। পুরুষ থাকে পাহারায়। বউকে সে মাঝেমধ্যে পরম সোহাগে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ডিম ফোটে ৪২-৪৪ দিনে।