জলবায়ু সম্মেলনে কী পেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও জলবায়ু সম্মেলনে সব সময় গুরুত্ব পেয়ে আসছে। প্রশ্ন হলো, এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী কী।

বিশ্বনেতাদের মুখোশ পরে দাতব্য সংস্থা অক্সফামের কর্মীদের বিক্ষোভ। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে
ফাইল ছবি: এএফপি

জাতিসংঘের ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনটি নানা কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। করোনা মহামারিকালে এটিই ছিল রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় ১২ নভেম্বর সম্মেলনটি শেষ হয়। এখন এ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কী পেল, সেই মূল্যায়ন চলছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বনেতৃত্ব প্যারিস চুক্তি করে ২০১৫ সালে। এ চুক্তিতে চলতি শতাব্দী শেষে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এরপর পেরিয়েছে ছয় বছর। এ সময়ে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন কতটুকু এগোল, বাস্তবায়ন কোথায় আটকে থাকল, সেই আলোচনাও চলছে।

বৈশ্বিক পরিসরের এ আলোচনায় বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশ কতটুকুই–বা অবদান রাখতে পারবে, সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে এ প্রশ্ন ওঠা খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ গ্লাসগো সম্মেলন—বাংলাদেশ সব সময়ই বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে।

সম্মেলনের তিন অর্জন

গ্লাসগো সম্মেলনটি পরিচিতি পায় কপ ২৬ নামে। এর সফলতা হিসেবে শুরুতে ‘গ্লাসগো ইমার্জেন্সি ক্লাইমেট প্যাক্ট’ নামে একটি ঘোষণায় সব দেশের সম্মতি পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে অবশ্য ইমার্জেন্সি বা জরুরি শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।

কপ ২৬ সম্মেলনের তিনটি অর্জনের কথা বলছেন বিশ্লেষকেরা। ১. এ সম্মেলনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে নেতারা একমত হন। ২. প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা হিসেবে ‘প্যারিস রুল বুক’ চূড়ান্ত করা হয়। মানে হলো, প্যারিস চুক্তি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তার রূপরেখা তৈরি করা। ৩. ‘ক্লাইমেট প্যাক্টের’ আওতায় কোন দেশ কার্বন নিঃসরণ কতটা কমাবে, সে ঘোষণা দিয়েছে।

এর আগে প্যারিস চুক্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন দেশ কতটুকু কার্বন নিঃসরণ কমাবে, তা চূড়ান্ত ছিল না। বাংলাদেশ তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলন থেকে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এ সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত সব দেশ ঐকমত্যে পৌঁছাল।

সম্মেলনে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ এবারের জলবায়ু সম্মেলনে মূলত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জোটের মাধ্যমে কথা বলেছে। এ দুই জোটের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। ফলে তাদের ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ এ দুই জোটের দেশগুলোর পক্ষে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো ও তা পাওয়ার শর্ত শিথিলের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে সম্মেলনে উন্নত রাষ্ট্রগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী খাত কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। তারা জোর দেয় সৌরবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর।

ফাইল ছবি: এএফপি

সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ পরিকল্পনায় থাকা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে উল্লেখ করেন, সরকার ১০টি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে বাতিল করেছে। ভবিষ্যতের জ্বালানি হিসেবে বাংলাদেশ সৌরবিদ্যুতের দিকে মনোযোগ বাড়াবে।

কপ ১৫ থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ে

কপ ১৫ হিসেবে পরিচিত জলবায়ু সম্মেলনটি হয় ২০০৯ সালে। কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু বিপন্ন দেশ হিসেবে বাড়তি গুরুত্ব পায়।

ওই সম্মেলনে শিল্পোন্নত ধনী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত জলবায়ু বিপন্ন দেশগুলো মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে ছিল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রের জোট অ্যানেক্স-১, অন্যদিকে ছিল স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর জোট এলডিসি। মধ্যম অবস্থানে ছিল উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-৭৭ ও চীন।

শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির জোটের কয়েকটি দেশের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে একটি মিল ছিল। ২০০৫ সালের আগপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও কানাডা থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। ২০০৬ সাল থেকে শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় জি-৭৭ ও চীন জোটভুক্ত রাষ্ট্র চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোর নাম ওঠে। স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটস (এওসিস) মিলে তখন কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আওয়াজ তোলে।

কোপেনহেগেন সম্মেলন যখন কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হতে যাচ্ছিল, তখন শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী রাস লোকে রাসমুসেন ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন একটি শেষ চেষ্টা চালান। তাঁরা বিশ্বের ২৮টি দেশকে নিয়ে একটি জরুরি আলোচনায় বসেন। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও যুক্ত করা হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের নানা প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ ২৬) নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই রাজপথে সরব তরুণ পরিবেশবাদীরা। জলবায়ু–সংকট মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তাঁদের। শুক্রবার গ্লাসগোয়। ছবি: এএফপি

এরপর এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা দেড় থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে বাড়তে না পারে, সে ব্যাপারে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। যা পরে বিশ্বের সব রাষ্ট্র মিলে সই করে। ‘কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড’ নামে এ চুক্তি স্বীকৃত। এর ধারাবাহিকতায়ই ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি হয়।

অভিযোজন তহবিল দ্বিগুণ হয়েছে

জলবায়ুসংক্রান্ত জাতিসংঘের মূল তহবিল পাঁচটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এ তহবিলে ১০ হাজার কোটি ডলার জমা হওয়ার কথা ছিল। যদিও হয়েছিল ৭ হাজার কোটি ডলার। এ তহবিলের অর্থ নিয়ে যায় ঊদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো।

তিনটি তহবিলে বরাদ্দ বাড়লে বাংলাদেশের সুবিধা হয়। একটি হলো অভিযোজন তহবিল। এ তহবিলে মাত্র ৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার বরাদ্দ ছিল। বাংলাদেশ তহবিলটিতে বরাদ্দ চার গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। শেষ পর্যন্ত তা দ্বিগুণ করার পক্ষে রাষ্ট্রগুলো একমত হয়। আর ওই তহবিল যাতে সহজে পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করার বিষয়টিও প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে।

এর বাইরে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি তহবিল আছে। যেখানে এবার ৬০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ তহবিলও ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার কথা হয়েছে। জাতিসংঘের ‘গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাসিলিটি’ নামে একটি তহবিল আছে। সেখান থেকে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১০টি প্রকল্পে অর্থ পেয়েছে। এ তহবিলও বাড়ানো হয়েছে।

এ তিন তহবিলের বরাদ্দ বাড়ানোর ফলে বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে অর্থ পাওয়া সহজ হবে। এ বিষয়ে জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য চাপ তৈরি করা ছিল আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তবে আমরা যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতির শিকার হচ্ছি, তাই আমাদের জন্য দ্রুত ও বেশি পরিমাণে জলবায়ু তহবিল পাওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সহজে পাওয়া সম্ভব এমন তহবিলগুলোর বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। সফলও হয়েছি।’

অনেক পথ বাকি

কোপেনহেগেন থেকে গ্লাসগো সম্মেলনে বাংলাদেশ সমঝোতার আলোচনায় অনেক বিষয়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক তহবিল পাওয়া এবং বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে এখনো অনেক দূর্বলতা রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার জাতীয়ভাবে কার্বন নিঃসরণের অঙ্গীকার বা এনডিসি তৈরি করে জাতিসংঘের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু সেখানে শুধু হাতে গোনা কয়েকটি খাতের কার্বন নিঃসরণের তথ্য উঠে এসেছে। মূলত জ্বালানি, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের ফলে কী পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারবে, সেই হিসাব হয়নি। কার্বন বাণিজ্যসহ নানা খাত থেকে অর্থ পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনো বেশ কম। বনভূমি রক্ষা ও বনের জমিতে পুনরায় বনায়নের ফলে বাংলাদেশ কী পরিমাণ কার্বন ধরে রাখে, তারও কোনো হিসাব করা হয়নি।

এ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা যাতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। তবে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক তহবিলগুলো থেকে অর্থ পেতে জলবায়ু প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি ও তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।