টানা বৃষ্টিতে পানিবন্দী মানুষ

অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলে পঞ্চগড় পৌরসভার নিমনগর এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকালের ছবি l প্রথম আলো
অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলে পঞ্চগড় পৌরসভার নিমনগর এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকালের ছবি l প্রথম আলো

টানা বৃষ্টিতে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি উঠেছে। অনেক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে মাঠঘাট, ফসলি জমি। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষজন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

ভারী বর্ষণ ও উজানের পানিতে পঞ্চগড় শহরসহ পাঁচ উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। করতোয়া, মহানন্দা, ডাহুক, তালমা, করুম, ভেরসাসহ সব কটি নদীর পানি বেড়েছে। কিছু এলাকার মানুষ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় শিশু-নারীসহ লোকজন মানবেতর জীবন যাপন করছে। গতকাল শনিবার বিকেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনো খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও বোদা উপজেলা। করতোয়া ও মহানন্দা নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি, আমনখেত, রাস্তাঘাট। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি উঠেছে। অনেকের পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ভেরসা নদীর ওপর নির্মিত স্লুইসগেট খোলা যাচ্ছে না। গেটগুলো না খোলায় আশপাশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জেলা শহরের পৌর এলাকার নিমনগর, খালপাড়া, রামেরডাঙ্গা, রাজনগর, তুলারডাঙ্গা, সদর উপজেলার ধাক্কামারা, কামাত কাজলদীঘি, চাকলাহাট, পঞ্চগড় ইউনিয়ন, তেঁতুলিয়ার শালবাহান, দেবনগর, তীরনইহাট, বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন, বোদা পৌরসভা, বেংহারী বনগ্রাম, কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ, মাড়েয়া ইউনিয়নের কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল কয়েকটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের তিস্তা, ধরলা, রতনাই, সানিয়াজানসহ প্রায় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নদীতীরবর্তী নিমাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। ধরলার প্রবল পানির তোড়ে দুপুরে সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের বুমকা পয়েন্টে ওয়াপদা বাঁধের ৫০ মিটার ও কুলাঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ শিবেরকুটি গ্রামে ওয়াপদা বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙে গেছে। শিবেরকুটি ওয়াপদা বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ধরলা ও রতনাই নদ-নদীর পানির তোড়ে কুলাঘাট পাকার মাথা এলাকার পাকা সড়কের প্রায় ১৫০ মিটার ভেঙে ১০টি বাড়িঘর ভেসে গেছে। জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের মাধ্যমে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি নজরে রাখা হচ্ছে।

তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে নীলফামারীর সৈয়দপুরে ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। শহরে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। ইতিমধ্যে পুরোনো মুন্সিপাড়া, হাতিখানা, বাঁশবাড়ী ২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়ে অনেক দোকানেও উঠতে শুরু করেছে পানি। তলিয়ে গেছে কৃষকের আবাদি জমি, ফসল।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সৈয়দপুর শহরের পুরোনো মুন্সিপাড়ার চিত্র খুবই করুণ। একই অবস্থা হাতিখানা আর বাঁশবাড়ীতেও। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজে কোমর পর্যন্ত পানি তো আছেই, বাড়িতেও উঠেছে হাঁটুপানি। মহিলা কলেজ, সানফ্লাওয়ার স্কুল ও কলেজ, ইসলামিয়া স্কুল, শেরেবাংলা স্কুলসহ এলাকার আশপাশে পানি আর পানি। বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন, খাতামধুপুর, কামারপুকুর, বাঙালীপুর, কাশিরাম বেলপুকুর ইয়নিয়নের অনেক গ্রাম এখন পানির নিচে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে টাঙ্গন, কুলিক, নাগরসহ নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলায় প্রায় চার হাজার পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়। এতে নদ-নদীগুলোর পানি বেড়ে যায়। গতকাল নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করে। এতে পৌর এলাকার ডিসিপাড়া, জলেশ্বরীতলা, খালপাড়া, গোয়ালপাড়া, হাজিপাড়া, টিকিয়াপাড়াসহ আট-নয়টি মহল্লা ও সদর উপজেলার আকচা, দেবীপুর, রাজাগাঁও, রায়পুর, কালিতলা, বড়গাঁওসহ বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল, হরিপুর ও পীরগঞ্জের প্রায় ২৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পৌরসভার খালপাড়া এলাকা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে পানিবন্দী মানুষ। গতকালের ছবি l প্রথম আলো
পৌরসভার খালপাড়া এলাকা থেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে পানিবন্দী মানুষ। গতকালের ছবি l প্রথম আলো

ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র ফয়সল আমীন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সদর উপজেলার চেয়ারম্যান তৈমুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল বলেন, পৌর এলাকায় দুই হাজার ও অন্য উপজেলায় আরও দুই হাজার পরিবার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে।

দিনাজপুরে বৃষ্টিতে তিন সহস্রাধিক মাটির বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দিনাজপুর শহরসহ অনেক উপজেলার রাস্তাঘাট, কবরস্থান পানিতে ডুবে গেছে। তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ।

সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জানা গেছে, বৃষ্টিতে দিনাজপুর উপশহর, পাটুয়াপাড়া, গোলাপবাগ, গোবরাপাড়া, পিটিআই মোড়, পুলহাট, কাঞ্চনমোড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। শহরের মুন্সিপাড়া, সাদুর ঘাট, হঠাৎ পাড়া, পৌরসভার সামনের রাস্তা, বালুয়াডাঙ্গা, ক্ষেত্রিপাড়া, রামনগর, পিটিআই, লেবুর মোড়, কাজলের মোড়, পুলহাটসহ শহরের অনেক সড়ক তলিয়ে গেছে। শহরের লালবাগ কবরস্থান ডুবে গেছে। এদিকে বৃষ্টিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খানসামা উপজেলা। ইউএনও সজিবুর রহমান বলেন, উপজেলার প্রায় ১ হাজার বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বীরগঞ্জে প্রায় ৫০০ ও কাহারোলে ৪০০ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিলি শহর প্রায় পুরোটাই পানিতে ডুবে যায়। ঘোড়াঘাটে শতাধিক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গাইবান্ধায় বৃষ্টির সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। করতোয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একাধিক এলাকায় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের ধানগড়া, পাঙ্গাসী, ব্রহ্মগাছা, সোনাখাড়া ও চান্দাইকোনা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে ভোগান্তি বেড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে।

{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরবিরামপুর, গাইবান্ধা, সৈয়দপুর (নীলফামারী), রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি)}