দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে হিমালয়ি গৃধিনী

উদ্ধার করা একটি হিমালয়ি গৃধিনীকে খাওয়াচ্ছেন একজন স্বেচ্ছাসেবক। গত মঙ্গলবার সকালে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা

হিমালয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাখি হিমালয়ি গৃধিনীগুলো প্রতিবছরই শীতকালে বাংলাদেশে বেড়িয়ে যায়। আসলে হিমালয়ের শীতের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে আসতে বাধ্য হয়। তবে লম্বা ভ্রমণপথের ক্লান্তিতে প্রতিবছরই দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় শ্রান্ত-অসুস্থ হয়ে এরা মাটিতে নেমে আসে, পড়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ।

দুই দিনে বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে এ রকম দুটি হিমালয়ি গৃধিনী (Himalayan Griffon) উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার অনন্তপুর গ্রাম থেকে একটি, এরপর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পাইকপাড়া মহল্লা থেকে আরেকটি শকুন উদ্ধার করা হয়।

বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ রাজশাহী কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবীর প্রথম আলোকে বলেন, তিরের কর্মীরা তাঁদের খবর দেন। পরে বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ও আইইউসিএন যৌথভাবে শকুন দুটো উদ্ধার করে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের উত্তরবঙ্গের শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের পরামর্শক মিজানুর রহমানের তত্ত্বাবধানে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘তির’-এর (টিম ফর এনার্জি অ্যান্ড ইনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ) স্বেচ্ছাসেবীরা একটি শকুন উদ্ধার করে। পরদিন আরেকটি শকুন উদ্ধার করা হয়। তিরের সদস্য সাব্বির আহমেদ সাকিলের তত্ত্বাবধানে দুটো শকুনকে প্রাথমিক পরিচর্যা দেওয়া হচ্ছে।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলমগীর কবীর প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার দুপুরের দিকে পাইকপাড়া মহল্লায় সাইদুল ইসলামের আমবাগানের গাছ থেকে পড়ে আহত হয় একটি বিশাল আকৃতির শকুন। স্থানীয়রা উত্ত্যক্ত করতে গেলে শকুনের ঠোঁটের কামড়ে দুজন আহত হন। খবর পেয়ে শিবগঞ্জ থানার পুলিশ শকুনটি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। পরে বন বিভাগকে বিষয়টি জানানোর পর তারা উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠায়। তাদের কাছে শকুনটি হস্তান্তর করা হয়েছে।সুস্থ হওয়ার পর শকুন দুটোকে দিনাজপুরের সিংড়া জাতীয় উদ্যানে ‘শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্রে’ রাখা হবে। আইইউসিএনের শকুন প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সারোয়ার আলম (সীমান্ত দীপু) প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে সাত প্রজাতির শকুনের মধ্যে রাজশকুন পুরো বিপন্ন হয়ে গেছে। এ দেশের স্থায়ী বাংলা শকুন ও সরুঠোঁটি শকুনের সংখ্যাও খুব কম। তাঁদের হিসাবে ২৬০টির মতো বাংলা শকুন রয়েছে। আর দেশে তিন প্রজাতির পরিযায়ী শকুন দেখা যায়। তার মধ্যে হিমালয়ি গৃধিনী অন্যতম।

দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত শকুনটি। ক্লান্ত দেহে গলা উঁচিয়ে রাখারও শক্তি নেই। গত মঙ্গলবার সকালে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ এলাকায়।
ছবি: সোয়েল রানা

গবেষক সীমান্ত দীপু বলেন, হিমালয়ে প্রচুর ঠান্ডা, হিম ঝড়ের কারণে নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে হিমালয়ি গৃধিনীগুলো সমতলের দিকে উড়তে শুরু করে। মার্চের দিকে আবার চলে যায়। একেকটা শকুনকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সমতলে এসে এরা পর্যাপ্ত খাবারও জোটাতে পারে না। তাই ভ্রমণক্লান্তিতে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় এদের মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রতিবছর এ রকম ১০০টির মতো শকুন এ দেশে আসে, যার মধ্যে ৪০টিই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

এ ধরনের শকুন উদ্ধারের জন্য ২০১৪ সালে আইইউসিএন একটি প্রকল্প নেয় দিনাজপুরের সিংড়া বনে শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র। গত ছয় বছরে ৯৯টি শকুন উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১৮টি হিমালয়ি গৃধিনী উদ্ধার করা হয়েছে। বগুড়া থেকে উদ্ধার করা শকুন দুটিকে দিনাজপুরে নিয়ে তিন মাস খাইয়ে-চিকিৎসা দিয়ে পরিচর্যা করা হবে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ছেড়ে দেওয়া হবে।

পরিচর্যা পেয়ে একটু শক্তি ফিরেছে। গত মঙ্গলবার সকালে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সুজাবাদ এলাকায়।
ছবি: সোয়েল রানা

গবেষক সীমান্ত দীপু জানান, এমনিতে একেকটি হিমালয়ি গৃধিনীর ওজন ১৩ কেজি পর্যন্ত হয়। তবে বাংলাদেশে এদের যখন পাওয়া যায়, তখন ওজন থাকে চার-পাঁচ কেজি। কয়েক দিন খাওয়ালেই এরা দ্বিগুণ ওজনের হয়ে আবার ফিরে যায়। মরা প্রাণীই এদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশে পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেন-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ওই সব ওষুধ প্রয়োগ করা প্রাণীর মৃতদেহ খাওয়ার পর শকুনেরা দ্রুত মারা যায়। এ ছাড়া খাদ্য ও বাসস্থান-সংকটে এই দেশে শকুনদের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

আইইউসিএন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, তবে এখন শকুন নিয়ে প্রচারণার ফলে যেকোনো জায়গায় শকুন পেলে মানুষ বন বিভাগ বা কর্তৃপক্ষকে খবর দেয়। ফলে সেগুলো উদ্ধার করা যায়। এ বছর মোটে তিনটি শকুনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শকুন ধরা পড়ার পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ বা তাঁদের খবর দেওয়ার অনুরোধ করেছেন আইইউসিএনের প্রতিনিধিরা।