ধনুক নামের প্রজাপতি

স্ত্রী ধনুক প্রজাপতি। ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল রমনা পার্ক থেকে তোলা l ছবি: লেখক
স্ত্রী ধনুক প্রজাপতি। ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল রমনা পার্ক থেকে তোলা l ছবি: লেখক

২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ছাত্রজীবনের বহু স্মৃতিই মনে পড়ছিল। প্রায় শুক্রবারই বাকৃবি বিজ্ঞান ক্লাব ও নেচার স্টাডি ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে এই বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরেছি, বার্ডিং করেছি ও নতুনদের পাখি চিনিয়েছি। ফুল-পাখি-প্রজাপতি নিয়ে কতই না সময় কাটিয়েছি। তাই বোটানিক্যাল গার্ডেনের চিরচেনা পথে হাঁটতে হাঁটতে স্মৃতিকাতর হয়ে যাচ্ছিলাম। পুরোনো সব স্মৃতি একে একে জেঁকে ধরছিল যেন আমাকে! হঠাৎই চোখের সামনে অতি চেনা একজনের আবির্ভাবে স্মৃতির জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, কাজেই পুরুষ পতঙ্গটিকে দেখে ক্লিক করতে ভুললাম না। কিন্তু আশপাশে স্ত্রীটির দেখা পেলাম না। তবে একই বছরের ২৯ আগস্ট আমার বর্তমান চাকরিস্থল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদের পাশের ঝোপে স্ত্রীটির দেখা পেলাম। 
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম, তারা প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি পতঙ্গ ধনুক প্রজাপতি। জামুই নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Great Egg Fly। এই প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম Hypolimnas bolina।
ধনুক মাঝারি থেকে বড় আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ডানার দৈর্ঘ্য ৭ থেকে ১১ সেন্টিমিটার। এ প্রজাতির পুরুষ-স্ত্রীর আকার-আকৃতি ও বর্ণে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। পুরুষ প্রজাপতির ওপরের দিক কালচে রামধনু রঙের। প্রতিটি ডানার মাঝখানে একটি করে ডিম্বাকৃতির সাদা ছোপ, যার কিনারা থেকে নীল রঙের দ্যুতি বের হয় যেন! সামনের ডানায় একসারি ছোট সাদা চক্র বা বৃত্ত রয়েছে। অন্যদিকে স্ত্রী প্রজাপতি আকারে বেশ বড় হয়। স্ত্রীর ডানা ও দেহের রং গাঢ় বাদামি। এদের দুই ডানায় ছোট, অস্বচ্ছ হলদে বা সাদা রঙের দাগ থাকে। ডানার নিচের দিকের রং বাদামি এবং তাতে সাদা রঙের ডোরা বা ব্যান্ড দেখা যায়। পুরুষ-স্ত্রী উভয়েরই সামনের ডানার গোড়ার দিক লালচে বর্ণের।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই এদের দেখা মেলে। তবে পাতাঝরা বন, ঘন ও স্যাঁতসেঁতে ঝোপ-জঙ্গল, বনের কিনারা, রাস্তার পাশ, মানুষের আবাস এলাকার আশপাশের বাগান বেশি পছন্দ করে। কিন্তু চিরসবুজ ও ঘাসবন এদের তেমন একটা পছন্দ নয়। এরা লম্বা শুঁড় দিয়ে ফুলের রস টেনে নেওয়ার সময় ডানা অর্ধখোলা অবস্থায় রাখে।
স্ত্রী ধনুক প্রজাপতি উপযুক্ত গাছের পাতার নিচের দিকে পাতাপ্রতি তিন থেকে ছয়টি করে ডিম পাড়ে। ফ্যাকাশে ও কাচের মতো স্বচ্ছ সবুজ ডিমগুলো দেখতে গম্বুজের মতো। স্ত্রী অত্যন্ত সন্তানবৎসল; ডিম ও শুককীটের প্রতি বেশ যত্ন নেয়। এদের ডিম ও শুককীট পিঁপড়ার আক্রমণের শিকার হতে পারে, সে কারণেই স্ত্রী প্রজাপতিকে সাবধানতার সঙ্গে উপযুক্ত গাছ খুঁজতে হয়। স্ত্রী যে পাতায় ডিম পাড়ে, সে পাতাটিকে সব সময় পাহারা দিয়ে রাখে। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার এমন উদাহরণ অন্যান্য প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না।
ডিম ফুটে শুককীট বের হতে প্রায় চার দিন সময় লাগে। শুককীটগুলোর দেহ কালো ও মাথা কমলা। পুরো দেহ কালচে-কমলা কাঁটায় মোড়া থাকে। মাথায় রয়েছে একজোড়া কালো শিং। এরা বেশ কয়েকবার দেহের চামড়া খসিয়ে বা মল্টিং করে শুককীটে পরিণত হয়। শুককীটের রং বাদামি, ডানা যেখানে থাকে সে অংশটা ধূসর। শুককীটের দেহের ওপরটা খসখসে। পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি দুই সপ্তাহ বাঁচতে পারে।
বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চলে এদের দেখা যায়।