নজরের বাইরে ‘নীরব ঘাতক’

আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে দেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের হালনাগাদ তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই।

বাড়ির পাশের নলকূপের পানি সাধারণত নিরাপদ মনে করেই মানুষ পান করে। সেই পানিতে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে কি না, পরীক্ষা না করে সেটি বোঝার উপায় নেই। আবার আর্সেনিকের কোনো গন্ধও নেই। শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া হয়েছে কি না, সাধারণ মানুষ তা জানতে পারে কয়েক বছর পর। তখন চামড়ায় ফুসকুড়ির মতো গোটা ওঠে। চামড়া খসখসে হয়ে যায় এবং ঘা দেখা দেয়। এর পরিণতি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।

দেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বা তাদের চিকিৎসা-পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সে হিসাবে দেশের ১ কোটি ৯৮ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বার্ষিক বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৯ অনুয়ায়ী, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮১ লাখ।

২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘গণবিষের’ উদাহরণ বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রতিবছর আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার কারণে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যায়। তখন এই তথ্যের প্রতিবাদ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু আর্সেনিকের কারণে বছরে কত মানুষের মৃত্যু হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিতে পারেনি।

সারা দেশে পানি সরবরাহের দায়িত্ব (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার আওতাধীন এলাকা বাদে) জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই)। সর্বশেষ ২০০৩ সালে দেশের নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছিল। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আর্সেনিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীহুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৩ সালে দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। এরপর গত ১৭ বছরে কোনো সমীক্ষা হয়নি। ফলে দেশের কত নলকূপে এখন সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে, সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে কেউ চাইলে এখনো নলকূপে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে আর্সেনিক রয়েছে কি না, সেই পরীক্ষা বিনা মূল্যে করাতে পারে। এ জন্য উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।

আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্তু যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়ে যায়, তখনই তা পানকারীর শরীরের নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে। দেশে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নলকূপের পানিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

যাদের শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ধরা পড়ে, তাদের ‘আর্সেনিকোসিসে’ আক্রান্ত রোগী বলা হয়। এমন রোগীদের শনাক্ত করতে ২০১২ সালে সরকার একটি জরিপ করেছিল। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ ধরনের রোগীর তথ্য সংগ্রহ করেছিল। তাতে দেখা যায়, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ রোগী সেবা নিয়েছেন।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় ১৬৭ জনের আর্সেনিকোসিস রোগ শনাক্ত হয়েছিল ২০১২ সালে। উপজেলার জামাল ইউনিয়নের তালিয়ান এবং নাটোপাড়া গ্রামের প্রায় শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক ধরা পড়ে। এই দুই গ্রামে ৩০ জন নারী-পুরুষ আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। গ্রাম দুটিতে সরকারিভাবে ২০টি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়।

জামাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তালিয়ান ও নাটোপাড়া গ্রামের নলকূপে ব্যাপকভাবে আর্সেনিক রয়েছে। ঘরে ঘরে তো আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ দেওয়া সম্ভব নয়। গ্রাম দুটিতে কয়েকটি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে আরও গভীর নলকূপ স্থাপন করা প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি কর্মসূচির আওতায় আর্সেনিক রোগীদের চিকিৎসার বিষয়গুলো দেখা হয়। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক (ডিপিএম) শাহনেওয়াজ পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশে আর্সেনিকোসিসের কত রোগী রয়েছে, সেটির হালনাগাদ তথ্য নেই। আর্সেনিকের কারণে দেশে প্রতিবছর কত লোক মারা যায়, সে তথ্যও নেই। তিনি বলেন, আর্সেনিকোসিসের রোগী নির্ণয়ে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। কিন্তু এ–সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম না থাকায় রোগী থাকলেও হয়তো তাঁরা শনাক্ত হচ্ছেন না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আর্সেনিক বিষয়ে সচেতন করার কাজ করা হয়। আর্সেনিক রোগী চিহ্নিত করা, সাধারণ মানুষকে আর্সেনিক বিষয়ে সচেতন করার মতো কোনো কার্যক্রম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই মুহূর্তে নেই।

২০১৯ সালে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই প্রকল্পের অধীনে গভীর নলকূপ, বৃষ্টির পানি পরিশোধন, পুকুরের পানি পরিশোধন, আর্সেনিকমুক্ত করার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হবে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫৪ জেলার নলকূপের আর্সেনিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হবে। যেসব নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া যাবে, সেটি লাল আর আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ সবুজ রং করা হবে। আর্সেনিকযুক্ত নলকূপগুলো প্রতিস্থাপন করা হবে প্রকল্পের আওতায়।

প্রকল্পের পরিচালক বিধান চন্দ্র দে বলেন, আগামী নভেম্বর মাসে নলকূপে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সে পরীক্ষা শুরু হবে। সমীক্ষা শেষ হলে দেশের কত নলকূপের আর্সেনিকের মাত্রা বেশি, তার সঠিক চিত্র বোঝা যাবে। তিনি বলেন, পার্বত্য জেলাগুলোসহ ১০টি জেলা বাদে বাকি ৫৪ জেলাতেই কম-বেশি আর্সেনিকের প্রকোপ রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি নিরাপদ পানির উৎস থাকতে হবে। এই লক্ষ্যে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।

বৈশ্বিক মাত্রার সঙ্গে পার্থক্য

এক লিটার পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক থাকলে তা নিরাপদ, সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মান এবং দেশীয় মানের পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ১৯৬০–এর দশকে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামে। এরপর ১৯৯৩ সালে তা দশমিক শূন্য ১ মিলিগ্রামে কমিয়ে আনা হয়। বিশ্বের সব দেশ আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা কমিয়ে আনলেও বাংলাদেশ ১৯৬৩ সালের সেই মাত্রা আর পরিবর্তন করেনি। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে, সে পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

তবে আর্সেনিকের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান সর্বজনবিদিত ও গ্রহণযোগ্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা বৈশ্বিক মানের সামঞ্জস্যপূর্ণ করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বৈশ্বিক মাত্রা বিবেচনায় নিলে দেশে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ, ৩ কোটি ১২ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে।

বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া বন্ধ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্সেনিকোসিসের চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। আর্সেনিকমুক্ত পানি ব্যবহারই সমস্যা সমাধানের প্রধান বিকল্প। তবে কিছু ভিটামিন এবং ওষুধ চামড়ার রুক্ষতা, ঘা নিরাময়ে কাজ করে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্তদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ডি কমপ্লেক্স ও আয়রন বড়ি দেওয়া হতো। এখন এই তিনটি বড়ির কোনোটি পান না রোগীরা।

আর্সেনিকমুক্ত হলেও নিরাপদ নয়

এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ এবং সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটির গত বছরের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, গভীর নলকূপের মাধ্যমে আর্সেনিকমুক্ত পানি পাওয়া গেলেও সেগুলো ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবমুক্ত হয় না। ফলে গভীর নলকূপের পানি মানেই নিরাপদ এটি বলা যাবে না। প্রতিটি গভীর নলকূপ ২০ থেকে ৪০ জন ব্যবহার করে। একটি গভীর নলকূপ বসানোর খরচ গড়ে ৬০ হাজার টাকা।

এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের গবেষণা বিভাগের প্রধান আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, গভীর নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া থেকে যাচ্ছে, এটি নতুন চ্যালেঞ্জ। অনিয়ন্ত্রিত গভীর নলকূপ হওয়ায় আর্সেনিকের স্তরও নিচে নেমে গেছে। আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হলেও অনেক ক্ষেত্রে আমজনতা এর সুবিধা পাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরাই এর সুবিধা নিচ্ছেন।

২০০৩ সাল পর্যন্ত আর্সেনিক নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প ছিল। এর আওতায় গ্রামে গ্রামে পরীক্ষা করে নলকূপে লাল চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হতো এর পানি পান বা রান্না করা যাবে না। ১৭ বছর এই কাজটি বন্ধ থাকায় আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও পুকুরের পানি পরিশোধন করে পানের পরামর্শ দিয়ে আসছেন তাঁরা। এ ছাড়া ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগী হতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

আর্সেনিক নিয়ে নীতিনির্ধারণে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর্সেনিক হচ্ছে নীরব ঘাতক। দেশ থেকে আর্সেনিক সমস্যা দূর হয়নি, এটি এখনো আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, বিষয়টি নিয়ে আগের মতো আর আলোচনা নেই। আর্সেনিক পরিস্থিতি, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং তাদের চিকিৎসার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ডিপিএইচই-এর কার্যক্রমে বড় ঘাটতি রয়েছে। সরকার বিশেষ নজর না দিলে দেশে আর্সেনিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না।