নদী রক্ষায় নির্দেশনা–সুপারিশ অনেক, বাস্তবায়ন কম

নদী রক্ষা ও উদ্ধারে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা আছে। নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশ আছে ১২২টি।

আজ বিশ্ব নদী দিবস। দখল-দূষণে দেশের নদীগুলো বিপন্নপ্রায়। প্রতিনিয়তই দখল হচ্ছে নদীর অংশ। অব্যাহত দখলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে আদি বুড়িগঙ্গাও। গতকাল লালবাগের শহীদনগর এলাকায়
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নদী অসহায়। নদী রক্ষায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। নদী উদ্ধারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সুপারিশও কাজে আসছে না। নদীবিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, নির্দেশনা ও সুপারিশ বাস্তবায়নে বড় আকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

দেশের নদ-নদী অব্যাহতভাবে দখল হয়েছে, হচ্ছে। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষর, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি-সাধারণ মানুষ—সমাজের প্রায় সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অবৈধভাবে নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৪৮ জেলার অবৈধ দখলদারের ৪৯ হাজার ১৬২ জনের একটি তালিকা করেছে। দখলের কারণে অনেক নদী ভরাট হয়েছে, নাব্যতা হারিয়েছে। দখলের পাশাপাশি নদ-নদী ব্যাপকভাবে দূষণের শিকার। দূষণে নদীর পানি ও নদীনির্ভর প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। দখল ও দূষণে দেশের অনেক নদী মৃত বা মৃতপ্রায়।

বিভিন্ন সময়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দখল ও দূষণ রোধে নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। আদালত রায় ও নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে বছরের পর বছর পার হলেও দখলকারীদের নানা উদ্যোগে ও আইনি জটিলতায় নির্দেশনার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

আদালতের রায় ও নির্দেশনাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আদালতের রায় বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদি সরকারের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তা হলে নদী দখলমুক্ত হবে কীভাবে?

৪ নদী রক্ষায় ১১ বছর আগের রায়

ঢাকার আশপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা—এই চার নদীর দূষণ, অবৈধ দখল ও নদীগুলোর ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের বৈধতা নিয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ আইনজীবী ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। এর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৪ ও ২৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠনসহ তিনটি বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়ে দেওয়া ওই রায়ে ৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনায় সিএস ও আরএস ম্যাপ অনুসারে নদীগুলোর সীমানা জরিপ করা, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ঘোষণা, নদীগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রণয়ন, সীমানা পিলার স্থাপন, নদী খনন ও পলিথিন ব্যাগসহ অন্যান্য বর্জ্য অপসারণসহ কয়েকটি বিষয় রয়েছে।

রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছে। বাকি কাজগুলো ঠিকমতো হয়নি।

বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী রক্ষায় রায়

বুড়িগঙ্গা নদীর পানিদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে এইচআরপিবির পক্ষে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করা হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্ট তিন দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন।

এই রায়ে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যার অগ্রগতি তিন মাস পরপর জানাতে বলা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীতে সংযুক্ত সব পয়োনালা (সুয়ারেজ) ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের লাইন ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে এ বিষয়ে প্রতি ছয় মাস পরপর অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ করতে বলা হয়।

কর্ণফুলী নদী রক্ষা ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালে আরেকটি রিট করে এইআরপিবি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। তখন নদীটির তীরে ২ হাজার ১৮১টি অবৈধ স্থাপনা ছিল।

রায়ে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে থাকা অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। রায় হাতে পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে স্থানীয় পত্রিকায় নোটিশ দিতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এসব স্থাপনা অপসারণ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

তুরাগ ‘জীবন্ত সত্তা’

২০১৬ সালের নভেম্বরে তুরাগ নদ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে আরেকটি রিট করে এইচআরপিবি। এর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ও ৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসহ ১৭ দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন হাইকোর্ট। এই রায়ে তুরাগ নদকে আইনি ব্যক্তিসত্তা বা জীবন্ত সত্তা ঘোষণার পাশাপাশি বলা হয়, বাংলাদেশের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সব নদ-নদী একই মর্যাদা পাবে।

তবে হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে তুরাগ নদের সীমানায় থাকা নিশাত জুট মিলসসহ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে, যা নিষ্পত্তি করে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষায় কোনো অবস্থাতেই তুরাগ নদ বা দেশের অন্য কোনো নদীর সীমানা ও তীরবর্তী জায়গা ইজারা বা বিক্রি করা যাবে না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকারকে অতিসতর্ক থাকতে হবে।

আপিলের রায়ে ১৭টির মধ্যে ৩টি নির্দেশনা সংশোধন ও একটি বাতিল করা হয়। তবে তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা (লিগ্যাল পারসন) ঘোষণা, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী-খালের আইনগত অভিভাবক ঘোষণা, কমিশনকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেওয়া নির্দেশনা বহাল থাকে।

নদী রক্ষায় করা ওই চার রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের কারণে রায় পুরোপুরি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর রায় পুরোপুরি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ চলছে। তিনি বলেন, তুরাগ জীবন্ত সত্তা বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়টি এসেছে সম্প্রতি। এই রায় বাস্তবায়নে আইনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এই রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দূর হবে।

কমিশনের ১২২ সুপারিশ

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বিভিন্ন মামলার রায়, আদালতের নির্দেশনা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পরামর্শসভার মতামত নিয়ে নদী রক্ষায় ১২২ দফার সুপারিশ তৈরি করেছে। ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে।

শুরুতে নদীর সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ দখলদার চিহ্নিতকরণ, দখলদার উচ্ছেদ ও নদী উদ্ধারে কমিশন ৩১টি সুপারিশ করেছে। নদী রক্ষায় আইনের প্রয়োগ কীভাবে করা সম্ভব, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, পুলিশ কী ভূমিকা রাখবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে।

কমিশন বলছে, দেশের সব নদীবন্দর থেকে ও সব নৌযান থেকে দূষিত তেল, ইপিজেডসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হয় নদীতে। নদীর সব ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও বন্ধে ২১টি সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতে ৩০ দফা, আইনি মোকাবিলা বিষয়ে ১০ দফা, জনসচেতনতা বাড়াতে ৯ দফা এবং গবেষণার জন্য ১০ দফা সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ৮টি সুপারিশ আছে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। সবশেষ আন্তসীমান্ত নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ৩টি সুপারিশ করেছে কমিশন। তাতে বলা হয়েছে, ভারত, চীন, নেপাল ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তসীমান্ত নদীর তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে ও আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলছেন, নদ-নদীর মালিকানা ও স্বত্ব জনগণের, এমনকি রাষ্ট্রেরও নয়। এই মালিকানা ও স্বত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার। সাহস করে সরকারি কর্মকর্তাদের আইনের প্রয়োগ করে যেতে হবে।