নদীতে বেড়া, নেতাদের মাছ চাষ

তিন কিলোমিটার অংশে বেড়া। নেপথ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। সাধারণ মানুষকে নদীতে নামতে মানা।

প্রবহমান নদীকে ‘বদ্ধ জলাশয়’ দেখিয়ে ইজারা নেওয়া হয়েছে। নদীর তিন কিলোমিটার অংশে মাছ চাষ করতে দেওয়া হয়েছে আড়াআড়ি বেড়া। স্থানীয় লোকজনের নদীতে নামা নিষেধ। নদী দখল করে মাছ চাষের এমন আয়োজন যশোর শহরের অদূরে মুক্তেশ্বরী নদীতে। তিন মাস ধরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও জনপ্রতিনিধি মিলে এভাবে মাছ চাষ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

যশোর শহরের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত মুক্তেশ্বরী নদী। শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার বালিয়া ভেকুটিয়া বাজার থেকে নদীতে বেড়া দেওয়া শুরু হয়েছে। সেখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আবরপুর ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় সেতুর পাশে আরেকটি আড়াআড়ি বেড়া দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মুক্তেশ্বরীর প্রবহমান ধারাটি সরু হয়ে গেছে। প্রস্থে কোথাও ১২০, কোথাও-বা ১৫০ ফুটের মতো। ইজারাদারের লোকজনকে ডিঙিনৌকা নিয়ে পাহারা দিতে দেখা যায়।

‘মুক্তেশ্বরী বাঁচাও আন্দোলন’ নামে স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি কমিটি আছে। নদীটি দখলমুক্ত করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কমিটির সদস্যসচিব আবদুল মাজেদ বলেন, প্রবহমান নদী কখনো ইজারা হতে পারে না। এটা জনগণের সম্পদ। এতে একমাত্র জনগণের অধিকার। সরকার কোনোভাবেই এটা ইজারা দিতে পারে না। অবিলম্বে ইজারা বাতিল করে নদীটি উন্মুক্ত রাখার দাবি জানান তিনি।

মুক্তেশ্বরী নদীকে ‘প্রবহমান নদী’ উল্লেখ করে ইজারা না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি চিঠিটি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চিঠির তোয়াক্কা না করে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ গত ৪ জুন জেলা জলমহাল কমিটির সভায় পাকদিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অনুকূলে তিন বছরের জন্য ভেকুটিয়া থেকে মন্ডলগাতি পর্যন্ত ১০৩ একর ৬৬ শতক নদী ইজারা দেন, যার বার্ষিক ইজারামূল্য ধরা হয় ৭ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা।

প্রবহমান নদী কখনো ইজারা হতে পারে না। এটা জনগণের সম্পদ। এতে একমাত্র জনগণের অধিকার। সরকার কোনোভাবেই এটা ইজারা দিতে পারে না।
আবদুল মাজেদ সদস্যসচিব, মুক্তেশ্বরী বাঁচাও আন্দোলন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নদীতীরবর্তী একাধিক বাসিন্দা বলেন, নদীটি উন্মুক্তই ছিল। অনেকেই মাছ ধরতেন। তা ছাড়া গোসল, সেচ, পাট জাগ দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে নদী ব্যবহার করতেন তাঁরা। গত জুন থেকে নদীটা আর জনগণের নেই। ইজারাদারেরা মাইকে প্রচার করেছেন, ‘নদী ইজারা নেওয়া হয়েছে, জনসাধারণ কেউ যেন নদীর পানিতে না নামে।’ এরপর দু-একজন নদীতে নামলে তাঁদের মারধর করা হয়েছে। ভয়ে এখন কেউ নদীর ধারে যান না।

স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকদিয়া মৎস্যজীবী সমিতিতে ৪০ জন মৎস্যজীবী সদস্য আছেন। তাঁদের বেশির ভাগ নদী ইজারা নেওয়ার কথা জানেনই না। সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নদীর ওই অংশ ইজারা নিয়েছেন।

ইজারা নেওয়া অংশে মাছ চাষের মোট অংশীদার ১৩ জন। এর মধ্যে মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি সরজিৎ বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক ঠাকুর দাস বিশ্বাসের দুটি অংশ। অপর ১১টি অংশ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আবরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি উজ্জ্বল রহমান, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম, মীর ফিরোজ ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আমিরুল ইসলামের একটি করে অংশ রয়েছে।

জানতে চাইলে ইউপি সদস্য উজ্জ্বল রহমান বলেন, ‘মাছ চাষের জন্য অনেক টাকাপয়সা লাগে। মৎস্যজীবীরা ওই টাকা দিতে পারেন না। এ জন্য আমরা তাঁদের সঙ্গে অংশীদার হয়েছি। ১৩টি শেয়ারের মধ্যে মৎস্যজীবীদের দুটি রয়েছে।’

আরবপুর ইউপির সদস্য ও ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘মৎস্যজীবী সমিতি নদীতে মাছ চাষ করলে স্থানীয় মানুষ ঝামেলা করে। এ জন্য আমরা পাঁচ-সাতজন তাদের একটু দেখভাল করি।’

সাধারণ মানুষকে নদীতে নামতে না দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাকদিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি সরজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘মানুষকে নদীতে নামতে দেব কেন? আমরা তো সরকারের কাছ থেকে লিগ্যালি (বৈধভাবে) নদী ইজারা নিয়ে অনেক টাকা খরচ করে মাছ ছেড়েছি। নদীতে কেউ যাতে না নামে, এ জন্য মাইকে প্রচার চালানো হয়েছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যশোর জেলার আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নদী মুক্ত, নদীর পানি যে পর্যন্ত যাবে, সে পর্যন্ত নদীর সীমানা। নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কোনো সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে বর্তমান জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, নদীর এই অংশ আগেও ইজারা হয়েছে। ইজারা না দেওয়ার জন্য পাউবোর দেওয়া চিঠি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। যে কারণে মৎস্যজীবীদের অনুকূলে নদী ইজারা দেওয়া হয়।