নদীভাঙন ও পদ্মা সেতু নিয়ে সতর্কতা

পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১৪ কিলোমিটার নদী প্রশিক্ষণকাজের ব্যবস্থা রয়েছে। তারপরও এখনো কেন এত ব্যাপক ও তীব্র ভাঙন চলছে?

পদ্মায় পানি বেড়েছে। এ কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার কুমারভোগ সেতু নির্মাণ প্রাঙ্গণের একটি অংশ ভাঙনের কবলে পড়ে। গত ৪ আগস্ট দুপুর
ছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতুর বাঁ দিকের তীরের ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে আনুমানিক ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার ভাটিতে এবং শিমুলিয়া ফেরিঘাটের অব্যবহিত উজানে কুমারভোগ এলাকায় সেতু নির্মাণ প্রাঙ্গণের একটি অংশ পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। গত ৫ আগস্ট ডেইলি স্টার-এ এ নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩১ জুলাই বেলা ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে অংশটি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। খবরটি আমাকে গভীরভাবে বিচলিত করেছে।

মনে পড়ে পদ্মার স্রোতোধারা, ফেরি পথ, নিচু চররাশি, যথেষ্ট পরিপক্ব ও উঁচু বিশাল চররাশি। আরও আছে তীর সংলগ্ন স্থানে বালি, পাথরের উঁচু স্তূপ, রাশি রাশি ব্লক। নদীর দুই কুলে বিশাল প্রান্তর জুড়ে পদ্মাসেতুর নির্মাণ প্রাঙ্গণ ও নির্মাণের মহা কর্মযজ্ঞ। পদ্মার গতিপ্রকৃতি এবং সেতু নির্মাণের মহা কর্মযজ্ঞের তীব্র ভাঙনের সংবাদটি কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসে।

কুমারভোগ এলাকার এই ভাঙনই শেষ ভাঙন নয়। ছয় দিন পর ৬ আগস্ট এর ভাটিতে শিমুলিয়া ফেরিঘাট এলাকায় ৪ নম্বর ফেরিঘাট ব্যাপক ভাঙনের শিকার হয়। ভাঙনের তীব্রতায় ওই ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভাঙনের ঘটনা আগেও ঘটেছে।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে মাওয়া বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট অঞ্চল এবং এর উজান-ভাটির কিছু এলাকাসহ বৃহৎ জায়গা ব্যাপকভাবে ভাঙনের কবলে পড়ে। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। বহুদিন ধরে বহু মানুষ ভাঙন দেখতে যেত। ভাঙনের আকস্মিকতা ও তীব্রতা এমনই ছিল যে জীবন্ত খাঁড়া গাছ প্রায় সোজা দেবে গিয়ে নদীতে ডুবে যায়। এলাকার মানুষের মতে, দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল ও এর উজান-ভাটির এলাকায় ভাঙন এতটাই বিস্তৃত ছিল যে অধিগ্রহণ করা ভূমির প্রায় পুরোটাই নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

২০১৩ সালের আগেও মাওয়া বাসস্ট্যান্ডের উজানের এলাকা—কান্দিপাড়া, দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল, কবুতরখোলা এলাকা ভাঙনে পড়ে। যত দূর মনে পড়ে এমন তীব্র ভাঙনের পর ২০১২ সালে ফেরি কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে এক কিলোমিটার ভাটিতে মাওয়া রাস্তার প্রান্তে ফেরিঘাট বসায়। ব্লক দিয়ে প্রতিরোধের একাধিক নিষ্ফল চেষ্টাও চলে।

কুমারভোগের উল্লিখিত নির্মাণ প্রাঙ্গণের একটি অংশ নদীতে ভেঙে পড়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। অতীতে মাওয়া ঘাট থেকে ফেরি, লঞ্চ ইত্যাদি সব নৌযান প্রায় সোজাসুজি চরজানাজাত ঘাটে চলাচল করত। চরের মধ্যকার চ্যানেল দিয়ে সম্ভবত ২০১৩ সালের পরে বর্ষা মৌসুমের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পরে শিমুলিয়া বরাবর নদী পার হয়ে চরের মধ্য দিয়ে যাওয়া রুটটি ধরে নৌযানগুলো চরজানাজাত পর্যন্ত চলাচল করত। রুটটি নিয়মিত ও বারবার খননের মাধ্যমে ফেরি চলাচলের জন্য কোনোভাবে নাব্যতা রাখা হয়। ফেরি পরে চরজানাজাত থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার ভাটিতে কাঁঠালবাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হয়। এই ফেরি রুটের চরজানাজাতের উজানে একেবারে মাথার অংশের সঙ্গে যোগাযোগ বহু আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু
ফাইল ছবি

শিমুলিয়া ফেরিঘাট থেকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়া-আসার পথে মূল নদী পাড়ি দিয়ে ফেরি থেকে তাকালে ফসলের খেত, মানুষের অসংখ্য বসতি, গাছপালা, টিনের তৈরি বাড়িঘর, এমনকি ইটের তৈরি বাড়ি চোখে পড়বে। প্রায় দুই দশক ধরে সেতু এলাকার বেশ উজান থেকে পদ্মা পুরোপুরি বাম তীরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। এই সময়কালে চরের মধ্য দিয়ে যে স্রোতোধারা প্রবাহিত ছিল সেগুলো হয় মরে গেছে নতুবা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়েছে। বিশেষ করে এই সব সরু চ্যানেলের মুখগুলো ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা কি এসব ঘটনায় কিছুর আভাস পাই?

একনজরে পদ্মা সেতু

সেতুর সমীক্ষা ও নকশার সময়কাল, ব্যয়, নির্মাণের সময়সীমা ইত্যাদির দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক। ১৯৯৮ সালে প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কাজের মধ্য দিয়ে সেতু প্রকল্পের কর্মকাণ্ডের শুরু। ২০০৩-০৫ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছে। রেলসংযোগ ছাড়া তখন প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১২৫ দশমিক ৭ কোটি ডলার। নির্মাণকাল ধরা হয়েছিল ৪ দশমিক ৫ বছর। ২০০৭ সালে রেলসংযোগ ছাড়া প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ২০০৯-১১ সালে বিস্তারিত নকশা সম্পন্ন হয়। বিস্তারিত নকশার পর রেলসংযোগসহ প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের নভেম্বরে সেতুর ভৌত নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রাক্কলিত নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা ছিল ২০১৮ সাল। এই প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে নদী প্রশিক্ষণ কাজের জন্য ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর পরামর্শ কাজের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৬৭৮ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এই অনুপাতে হিসাব করলে সর্বশেষ মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের, অর্থাৎ ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মধ্যে নদী প্রশিক্ষণকাজ উপাংশের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পুনর্বিন্যস্ত ডিপিপি অনুযায়ী ২০১৯ সালে পুনঃ প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা; নির্মাণকাজ সমাপ্তির প্রাক্কলিত সময়সীমা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস। পরবর্তী সময়ে নির্মাণকাজের প্রাক্কলিত সময়সীমা হয় ২০২১ সালের জুন মাস। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাসের আগে সেতুর কাজ শেষ হবে না, তবে ব্যয়ও বাড়বে না (ডেইলি স্টার, ২৭ আগস্ট ২০২০)। ২২ বছরের অনেক ঘটনা ও পরিবর্তন সেতু প্রকল্পের চোখের সামনেই তাহলে ঘটেছে।

ফিরে আসি ভাঙনের কথায়। নদীটি এখনো কেন এমন ভাঙন ঘটিয়ে চলেছে, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সেতু কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে তার উত্তর খুঁজতে হবে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের অনুধাবন এই যে, সেতু প্রকল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ছোট-বড় সবার সব মনোযোগ পদ্মা সেতুর দিকে, পদ্মা নদীর দিকে নয়।

ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত সংবাদে উঠে আসা ভাঙনের ব্যাপকতা ও তীব্রতার দিকে তাকানো যাক। শুধু নির্মাণ প্রাঙ্গণের বিপুল ভূমিই নয়, পদ্মায় নিমজ্জিত হয়েছে নির্মাণ কোম্পানির নির্মিত বা সংগৃহীত ন্যূনপক্ষে ১৯২টি রেলওয়ে স্ট্রিনজার ও ২২০টি সড়ক ডেক। ঠিকাদারের প্রাথমিক হিসাবমতে, ক্ষতির পরিমাণ ৯০ কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের কর্ম কুশলীরা দিনরাত সেখানে উপস্থিত। আমাদের এই অনুমানও কি তাহলে যথার্থ নয় যে সবার মতো নির্মাণ ঠিকাদারদেরও সব মনোযোগ পদ্মা সেতুর দিকে, নদীর দিকে নয়?

২০১৪ সালের নভেম্বরে সেতুর ভৌত নির্মাণকাজ শুরু হয়
ফাইল ছবি

সমস্যা নতুন নয়

অতীতে বহুবার, প্রায় প্রতিবছর, ভরা বর্ষায় নদী পার হয়ে ফেরিপথের শুরুতে ফেরি আটকে পড়েছে, ফেরিপথের মুখ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, দিনের পর দিন ফেরি চলাচল পুরো বন্ধ থেকেছে, ফেরিঘাটে আবার চলাচল শুরুর অপেক্ষায় থাকা শত শত যানবাহনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ বছরও এ সমস্যা প্রকট। ২৯ আগস্ট রাতে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর ৩ আগস্ট থেকে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল আট দিন। শুকনো মৌসুমে পানি বেশ নিচে নেমে যায়। কিন্তু সেতু এলাকায় শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে পানিপ্রবাহের ঘাটতি নেই। তাহলে এই সময়ে কেন ফেরি আটকে পড়ছে? এ নিয়ে কি সেতুসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনে কোনো ভাবনার উদ্রেক হয়েছে? নাকি এই সব শুধু ফেরি কর্তৃপক্ষের ব্যাপার?

এবার আসি নদী প্রশিক্ষণকাজের কথায়। সেতু নির্মাণের প্রধান উপাংশগুলোর মধ্যে নদী প্রশিক্ষণের কাজ একটি বড় স্থান নিয়ে আছে। ব্যয়ের প্রায় ৩৩ শতাংশ। এ হলো নদীতীর বেশ গভীর থেকে বাঁধাই করার কাজ (bank armouring)। মাওয়া প্রান্তে এ কাজের পরিমাণ ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং মঙ্গল মাঝির ঘাট প্রান্তে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার। মোট ১৪ কিলোমিটার। আমাদের প্রশ্ন সরল, নদীর কোন পাড় ভাঙনপ্রবণ? এ প্রশ্নের উত্তর সেতু কর্তৃপক্ষকে গভীরভাবে খুঁজতে হবে। এযাবৎ ভাঙনের সব তাণ্ডবই বাঁ দিকের তীরে দেখলাম। তাহলে ডান তীরে ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার কেন? ১২ দশমিক ৪ কিলোমিটার কাজের পুরোটাই কি প্রয়োজনীয়? কার ভয়ে, কী রক্ষার্থে? ওই ১৪ কিলোমিটার কাজকে নদী প্রশিক্ষণের কাজ বলা খুব সমীচীন মনে হয় না, যদিও সেতু প্রকল্প নাম দিয়েছেন নদী প্রশিক্ষণকাজ (River Training Works)। বরং একে নদীতীর রক্ষাকাজ (River Bank Protection Works) বলাই অধিক সংগত।

বঙ্গবন্ধু সেতুর অভিজ্ঞতা

আমরা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের কথা স্মরণ করতে পারি। আশির দশকের শেষার্ধে সমীক্ষা শুরু হয়ে তিনটি সরকারের আমলেই কাজ অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে ভৌত কাজ সূচনার পর ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ শুরু হয়। শেষ দুই বছরে কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে কর্মকাণ্ডের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। ২৩ জুন সেতুটি কমিশন লাভ করে। এই সেতুর পরিকল্পনা, নকশা ও নির্মাণকালে আমাদের দেশ তত অগ্রসর ছিল না। এখন আমরা অর্থে, বিত্তে, শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে এগিয়ে। তাহলে এত হোঁচট খাচ্ছি কেন? কর্মপরিকল্পনা ও সম্পাদনের পরম্পরায় কি কোনো ঘাটতি থেকে গেল? বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড়ে নদী প্রশিক্ষণের কাজের দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটারের একটু কম, পশ্চিম প্রান্তে ৩ কিলোমিটারের একটু বেশি। দুই পাড় মিলিয়ে ঋজু অংশ ৪ কিলোমিটারের মতো হবে। প্রশ্ন জাগে, পুরোটা যদিও নির্মিত হয়নি, তবু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে ১৪ কিলোমিটার নদী প্রশিক্ষণের কাজের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এখনো কেন এত ব্যাপক ও তীব্র ভাঙন চলছে?

নদী ভাঙনের সমস্যা নতুন নয়
ফাইল ছবি

নদী প্রশিক্ষণ

আমাদের মনে এমন ধারণাই জাগে যে প্রশিক্ষণের কারণে নদী প্রশিক্ষিত হয়ে উঠবে। তাহলে নদী প্রশিক্ষণের বেলায় আমাদের প্রত্যাশাটা কী হওয়া উচিত? সরল কথায় প্রত্যাশা এই হওয়া উচিত যে নদী তার ওপর অর্পিত বোঝা-চলমান জলরাশি এবং এতে মিশ্রিত পলল নদীতীরের তেমন কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে ভাটির দিকে নিয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো বিপুল অর্থে নির্মিত নদী প্রশিক্ষণকাজ থেকে আমরা কাঙ্ক্ষিত উপকার পাচ্ছি কি? নির্মাণ শেষে পাব কি? না পেলে ভবিষ্যতে সেতু নিরাপদ থাকবে কি?
শুনতে পাই, সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন উল্লিখিত ভাঙন সেতু এলাকার বাইরে। এতে সেতুর কোনো ক্ষতি হবে না। আরও বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
প্রথমেই প্রশ্ন জাগছে, সেতু এলাকা বলতে আমরা কী বুঝব। অবধারিতভাবে শানবাঁধানো এলাকাই (hardened area) কি সেতু এলাকা? নদীবন্দরের জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ঘোষিত নির্ধারিত সীমা আছে। সেতুর জন্য কি তেমন কোনো ঘোষিত সীমা আছে? শানবাঁধানো এলাকা পর্যাপ্ত না হলে অথবা শানবাঁধানো এলাকা যথেষ্ট দৈর্ঘ্যের থাকা সত্ত্বেও নদী আক্রমণ করে সেতুকে আপদগ্রস্ত করে তাহলে সেতু কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে কি? বাপাউবো সারা দেশের নদীভাঙন রোধের কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। তারা যদি কোনো কারণে সময়মতো সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারে, তাহলে সেতু কর্তৃপক্ষ কি সেতুকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারবে? তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শানবাঁধানো এলাকাই সেতু এলাকা বিবেচিত না হয়ে, ঝুঁকি তৈরি হতে পারে এমন প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন এলাকা সেতু এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত কি না, তা সেতু কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে।

আমরা দেখতে পাই প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে জরুরি কাজ হিসেবে ভাঙনরোধ চেষ্টার কাজে বালুভর্তি হাজার হাজার বস্তা নদীতীরে, নদীগর্ভে ফেলা হয়। অতীতে কোনো এক বছর আমরা টেলিভিশনে সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনৈক ব্যক্তির মুখে শুনেছি-ভয়ের কিছু নেই ৮২ হাজার বস্তা প্রস্তুত আছে। মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ অবশ্যই চলমান রাখতে হবে সেতু নির্মাণ সমাপ্তির পরেও। কিন্তু যদি এমন প্রয়োজন প্রতি বছর দেখা দেয় তাহলে যেমনি ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে তেমনি অনেক অর্থের অপচয় হবে। সবই নির্ভর করবে নদী প্রশিক্ষণের কার্যকারিতার ওপর।

সেতু প্রকল্পটি অনেক বাধার মুখে পড়ে ‘না হওয়ার পথে’ যাত্রা করেছিল। সেখান থেকে অসমসাহসী প্রধানমন্ত্রী ‘হওয়ার দেশে’ সেটিকে ফিরিয়ে এনেছেন। শুধু ফিরিয়ে এনেই তিনি ক্ষান্ত হননি, কারও দয়াপরবশ মুখের পানে তাকিয়ে না থেকে এই ক্ষুদ্র অর্থনীতি থেকেই সম্পূর্ণ অর্থায়নে সেতুটি নির্মিত হবে বলে ৯ জুলাই ২০১২ তারিখে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। অধিকন্তু সেতুটি এ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে সবার বিশ্বাস। এর সফল কর্ম সমাপ্তি ও কমিশনের মহাখুশির দিনটির দিকে দেশের প্রতিটি মানুষ চেয়ে আছে। কিন্তু এত সময় পেরিয়ে (সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পর ১৫ বছর, বিস্তারিত নকশার পর ৯ বছর, নির্মাণ শুরুর পর প্রায় ৬ বছর), এত অর্থ ব্যয় করে (৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে, সময় ইতিমধ্যে বেড়েছে, হয়তো ব্যয় আরও বাড়বে) যখন কোনো নাগরিক ভাঙনের এত বড় খবর পড়ে, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে: ঝুঁকি আদৌ দূর হয়েছে কি?

সতর্কতা

আমাদের সাধারণ পর্যবেক্ষণ-প্রসূত ধারণা এই যে সেতু এলাকায়, এর উজান ও ভাটি এলাকায় অতীতের পরিবর্তনসমূহ ও এগুলোর পরম্পরা, এবং বর্তমানের ভূমি ও নদী পথের বিভিন্ন উপাদান, উপাংশ, অর্থাৎ নদীর সার্বিক অবস্থান ইত্যাদি এই ইঙ্গিত দেয় যে, শুধু বর্তমানেই নয়, ভবিষ্যতে সেতু এলাকা নদী ভাঙনের ঝুঁকির মুখে থাকার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে এই ঝুঁকির পরিমাণের হ্রাস, বৃদ্ধি ঘটতে পারে বটে, কিন্তু ঝুঁকি বলবৎ থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়। এই সতর্ক বাণী উচ্চারণই এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। বাকি সব সাদামাটা গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। এই মর্মে আমাদের মতামত ও একান্ত প্রত্যাশা এই যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সতর্কবাণীটি বিবেচনাপূর্বক সেতুর অনুকূল নদী পরিবেশ তৈরি করবেন। আমাদের যৌক্তিক অনুমান এই যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সব দিক থেকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার চেয়ে বহুগুণে সাশ্রয়ী।

নদীকে উপেক্ষা না করে ভালোবাসতে হবে
ফাইল ছবি

নদীর অধিকারের প্রতি, নদীর প্রয়োজনের প্রতি, নদীর দেহের প্রতি, নদীর মর্যাদার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। স্থাপনা নির্মাণকৃত এলাকায় এর যেমন স্বাধীনতা থাকবে তেমনি এর ওপর নিয়ন্ত্রণও থাকবে। এই স্বাধীনতা-নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কের ব্যাপারে একটি উপকারী, সহনীয়, বন্ধুত্বসুলভ বন্ধন তৈরি করতে হবে। সেটিই স্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ। অবহেলা নয়, যত্ন করতে হবে। তাহলেই আমরা গাড়ি হাঁকিয়ে সেতুর ওপর দিয়ে নিরাপদে হাসিমুখে আমাদের অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাব।