ডিসেম্বর ১৯৯৬-এ বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সাইকেল আরোহী এক কিশোরের কাছে লালচে রঙের পাখিটিকে দেখি। সাইকেল থামিয়ে জানতে পারি এটিকে সে বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে বোঝাই বুনো পাখি ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। ভবিষ্যতে এ কাজ করবে না বলে দ্রুত সাইকেলে প্যাডেল মেরে ছেলেটি চলে যায়।
এরপর বহু বছর কেটে গেলেও লাজুক পাখিটির দেখা পাইনি কখনো। ১৪ নভেম্বর ২০২০ রাতে আচমকা একই রকম একটি পাখি জিগাতলায় আমাদের বাসার দোতলায় বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল। পাখিটির সামনে যেতেই সে যেভাবে ডানা ঝাপটে আক্রমণ করতে এল, তাতেই ওর পরিচয় পেয়ে গেলাম। পাখিটি কিছুটা আহত ছিল। ওকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পুত্র নাফিমকে খাঁচা আনতে পাঠিয়ে তিনতলায় নিজের ফ্ল্যাটে গেলাম ওষুধপথ্য আনতে। কিন্তু খাঁচা এলে দোতলায় নেমে শুনলাম বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে পাখিটি চলে গেছে। বাড়ির চারদিকে ভালোভাবে খুঁজেও ওর হদিস পেলাম না। সে কোত্থেকে এসেছিল, কিছুই বোঝা গেল না। হয়তো ওকে পুষতে বা ওর মাংসের স্বাদ নিতে কেউ এনে থাকবে। আর সেখান থেকে সুযোগ বুঝে পাখিটি পালিয়েছে।
সেদিন রাতের ক্ষণিকের এই অতিথি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি নলঘোঙ্গা। নলচোঙ্গা, রাঙ্গি বক, লাল বক, নল বক বা আগুনি বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম সিনামন বা চেস্টনাট বিটার্ন। গোত্র Ardeidae, বৈজ্ঞানিক নাম Ixobrychus cinnamomeus। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়াজুড়ে বিস্তৃত।
নলঘোঙ্গা লালচে-দারুচিনি পাখি। দৈর্ঘ্য ৩৬-৩৮ সেন্টিমিটার ও ওজন ১২১-১৫৪ গ্রাম। মাথা, ঘাড় ও পিঠ পোড়া ইটের মতো লাল। দেহের নিচটা হালকা লালচে। ঘাড়ের পাশে কালচে-বাদামি গোটা কয়েক টান আছে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রীর পালকে বাদামির ভাব বেশি। এ ছাড়া দেহের ওপরে কিছু ফ্যাকাশে ছোপ ও নিচের দিকে ডোরা থাকে। পুরুষের অক্ষিগোলকের চামড়া গাঢ় গোলাপি ও স্ত্রীরটি হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চোখ ও চঞ্চু হলুদ। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল সবুজাভ-হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্কগুলোর পিঠ হলদে আভাসহ কালচে-বাদামি। দেহের নিচে লম্বা কালচে-বাদামি দাগ থাকে।
নলঘোঙ্গা সারা দেশের বিল, ছোট জলাভূমি ও ধানখেতজুড়ে একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। তবে অত্যন্ত সতর্ক ও লাজুক হওয়ায় সহজে চোখে পড়ে না। তৃণভূমি, নলবন, ধানখেত বা জলাশয়ে চুপি চুপি হেঁটে হেঁটে ছোট মাছ, ব্যাঙাচি, জলজ কীটপতঙ্গ, শামুক ইত্যাদি খায়। ভোরবেলা, গোধূলিলগ্ন ও মেঘাচ্ছন্ন দিনে বেশি সক্রিয় থাকে। ওড়ার সময় ‘কক্-কক্-কক্...’ শব্দে ডাকে।
মে থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। এ সময় পুরুষ নলঘোঙ্গা গাছের ডালে বসে ‘গুক্-গুক্-গুক্...’ শব্দে বারবার ডাকে। পানি থেকে ৩০-৬০ সেন্টিমিটার ওপরে নুয়ে পড়া নলখাগড়া বা ঘাসের মধ্যে শুকনো ঘাস-লতা দিয়ে পুরো মাচানের মতো বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৩-৪টি, রং সাদা। স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৭-২২ দিনে। ১০ দিন বয়সেই ছানারা বাসা থেকে বেরিয়ে গাছে হাঁটাহাঁটি শুরু করে। তবে ওড়া শিখতে আরও সময় লাগে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।