নলবন ও পাখি

নলবন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কিনারা থেকে
ছবি: লেখক

বাংলাদেশের নদীর চরে, অগভীর হাওরে ও জলাভূমির তীর ঘেঁষে নলবন বা নলখাগড়ার ঝোপ একসময়ের নিয়মিত দৃশ্য ছিল। এসব নলবনে বাস করত নানা প্রজাতির পাখি। এগুলোর মধ্যে অনেক প্রজাতির রিড ওয়ার্বলার বা নলফুটকি, ছাতারে, বাংলা বাবুই, দেশি মেটে হাঁস, কালিম, কোড়া, ঘাস পাখি, নলঘোঙ্গা (এক প্রজাতির বক) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্বালানির জন্য ক্রমাগত আহরণের কারণে হাওর ও নদী এলাকা থেকে নলবন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে কারণে নলবননির্ভর পাখিরা আবাসের সংকটে ভুগছে। নলবননির্ভর অনেক পাখির প্রজননে ব্যাঘাত ঘটছে, কমছে তাদের সংখ্যা।

সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে নলবন রয়েছে। দেশি পাখিরা এই নলবনে বাসা বানায়। নলবন জলাশয়ের মাছের জন্য উপকারী। মাছের পোনারা নলবনে আশ্রয় খোঁজে। নল ভূমিক্ষয় রোধ এবং পানি বিশুদ্ধকরণে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের নদীর চরে, নিচু জলাভূমিতে ও অগভীর জলাশয়ে নলের যে প্রজাতিটি দেখা যায়, সেটি হলো ফ্র্যাগমিটিস কারকা।

দেশে নলবনের বর্তমান আয়তন কত, তা নিয়ে কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। গবেষণা হয়েছে সে রকম কোনো বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ চোখে পড়েনি। তবে ২০০৬ সালের সিলেট বন বিভাগের আওতাধীন ইন্টিগ্রেটেড রিডল্যান্ড অ্যান্ড সোশ্যাল ফরেস্ট্রি প্রকল্পের তথ্যমতে, সিলেটের গোয়াইনঘাট (সালুটিগড়, রাতারগুল, লক্ষ্মীনগর, গোয়াইনঘাট ও লামাছায়টান এলাকা), কোম্পানীগঞ্জ (ভাটারা, রানিখায়া ও হিলাকুরি), জৈন্তাপুর (জৈন্তাপুর ও জাফলং) এবং সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার ও ছাতক উপজেলার নলবনের পরিমাণ ২১ হাজার ৭২২ দশমিক
২৫ হেক্টর। দেশের প্রধান প্রধান নদীর চর এলাকায় নলবনের পরিমাণ নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

জার্মানির প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম জলাশয়ের চারদিকে নলের একটি প্রজাতি (Phragmites australis) লাগানো হয়। পাখির নিরাপদ বসতির জন্যও জার্মানরা অনেক জলাশয়ে নল বনায়ন করেছে। যে কারণে আবাসিক ও পরিযায়ী জলচর পাখি এবং নলবননির্ভর পাখি নিরাপদ থাকে। নলবনে বাসা বানায়। চারপাশে লম্বা ও ঘন নলবনের কারণে ওই সব পাখি মানুষের দৃষ্টির বাইরে থাকে।

নলের ফুলমঞ্জরি দিয়ে ফুলের ঝাড়ু তৈরি করা হয়। কচি কাণ্ড খাওয়া হয়। কাণ্ড ব্যবহার করা হয় টুপি ও মাদুর বানাতে। কোথাও কোথাও ঘরের বেড়া দিতে কাণ্ড ব্যবহার করা হয়। কাণ্ড জ্বালানি হিসেবে বহুল ব্যবহার করা হয় চর এলাকায়।

নল বহুবর্ষজীবী ও কিছুটা কাষ্ঠল প্রকৃতির ঘাস। এরা লম্বায় ৪-১০ মিটার হয়। কাণ্ডের ব্যাস প্রায় ২৫ মিলিমিটার। পাতা প্রায় ৮০ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এবং প্রস্থ প্রায় ৪ সেন্টিমিটার। উষ্ণমণ্ডলীয় এবং উপ–উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকার দেশে জন্মে, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা, নিউ গায়ানা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায়। বীজ ও রাইজোম থেকে বংশবৃদ্ধি হয়। পুষ্প বাদামি বর্ণের। এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফুল ফোটে।

দেশে নলবন নিয়ে গবেষণা যেমন দরকার, তেমন দরকার নল বনায়ন। আমাদের শহর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে নল বনায়ন প্রয়োজন। পাখির নিরাপদ আবাসের জন্য নল বনায়ন জরুরি।