নিরীহ এক গায়ক পাখি

ভ্যাদাটুনির ছবি শ্রীমঙ্গল থেকে তুলেছেন আদনান আজাদ।

ঘরে শুয়ে মধ্যরাত অবধি শুনলাম হালতির করুণ-সুরেলা ডাক। বাসা বেঁধেছে, ‘ডিম পাড়ার গান’ তো গাইতেই হবে! ২০২০ সালের মে মাসের শেষার্ধে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল আরেকটি পাখির ‘টুইটো টুইটো টুইট’ ধরনের সুরেলা কণ্ঠের মিষ্টি গান শুনে। এরা শিসধ্বনিও তোলে, মনকাড়া সেই সুরেলা শিস।

নিত্যপ্রতিবেশী এই পাখির স্বভাবই হলোÑকোনো গাছের পাতার নিচে বা অন্য কোনো আড়ালের ঝোপঝাড়ে বসে একটানা গান গাইবে ২০-৪০ মিনিট। শৈশব-কৈশোর থেকে দেখে আসছি পাখিটিকে।

৬০ বছর ধরে চিনি আমি এই ভোরের গায়ক পাখিটিকে। ভোরের আলো ফুটলে গান ছেড়ে এরা জোড়া বেঁধে খাবারের তল্লাশে বেরোয়। ছোট ও মাঝারি ঝোপঝাড়ে ছোট ছোট লাফ দিয়ে খাবার খোঁজে। সুপারি-নারকেলের চারার মাথা, লতাঝাড়, ঝুলন্ত শুকনা খেজুর-সুপারি ও কলাপাতায় ঝুলবে-দুলবে। ডোবা-নালা-জলাশয়ের পাড়ে যাবে। ঘুরবে নাটাকাঁটা ঝোপসহ আখ-পাট ও শাকসবজির খেতে। প্রয়োজনে মাটিতে নেমে ঝরা পাতা ওলটাবে।

বাগেরহাট অঞ্চলে এখনো বহু বাড়ির পর্দাবেড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয় সুপারির শুকনা পাতা, সেই পাতাতেও দুলে-ঝুলে খাবার খোঁজে। এদের মূল খাদ্য পোকামাকড়-লার্ভা-শুঁয়োপোকা-কেঁচো-ফড়িং ও উইপোকা। অতি নিরীহ আর ভদ্র স্বভাবের এই পাখিদের চোখে ভয় ভয় ভাব সর্বদা ফুটে থাকলেও মানুষকে তেমন ভয় পায় না। উঠোন-বাড়িতে আসে। বেজি-বনবিড়াল-গুইসাপ-পোষা বিড়াল দেখেও সতর্ক হয় না তেমন। চারণক্ষেত্র নিচুতে, এমনকি মাটিতেও। তাই বেজি-গুইসাপের শিকার হয়ে যায়। এরা অন্য পাখির সঙ্গে মোটেও ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়ায় না। টুনটুনির মতো ছোট পাখির তাড়া খেলেও মুখের খাবার ফেলে সরে যায়।

নিরীহ এই পাখিরা বোকারও হদ্দ, তা বোঝা যায় এদের বাসা বাঁধার জায়গা দেখলে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এরা এমন জায়গায় বাসা বানায়, যা দেখলে অবাক হতে হয়। যেমন খাড়া করে রাখা পাটখড়ির স্তূপের ফাঁকে ও আগার দিকে, পর্দাবেড়া হিসেবে ঝোলানো শুকনা সুপারিপাতার খোলার ভেতরে। ঘরের ডোয়ায় খাড়া করে ঠেস দেওয়া তাল-খেজুরের পাতা বা গোলপাতার ভেতরে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ে ২-৪টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১৩-১৭ দিনে। বাসার উপকরণ ছিলে ফেলা শুকনা সুপারির খোসা, ছিলা নারিকেলের খোসার শুকনা-শক্ত সুতা, বাঁশের শিকড় ও একধরনের লতা। আনারসগাছের মাথা ও সুপারিচারার মাথায়ও বাসা করে। বড়রা তো বটেই, এদের সদ্য উড়তে শেখা ছানারাও অনেকটাই কাঠঠোকরাদের মতো ছোট ছোট লাফে সরু সরু গাছ বেয়ে ওপরে যেমন উঠতে পারে, তেমনি নিচমুখী হয়ে নামতেও পারে, তেরছাভাবে দাঁড়াতেও পারে, শাঁই করে ঘুরতেও জানে। লম্ফঝম্ফও ভালো জানে। অ্যাক্রোবেটিক শরীর এদের। শীতকালে শরীরের পালক ফুলিয়ে একেবারে ছোটখাটো টেনিস বল হয়ে যায়। বৃষ্টি পড়লেও হয়। এই টেনিস বল হতে সর্বশেষ দেখেছি ২০১৯ সালের মে মাসের শেষার্ধে। গ্রামেই ছিলাম তখন। বাল্য-কৈশোর-তরুণবেলা ও এই বৃদ্ধবেলায় হালতির নিশিগান ও এই পাখিদের ‘ভোর সংগীত’ আমাকে অন্য জগতে নিয়ে যায়।

নিরীহ পাখিটির নাম মোটাঠোঁট ছোট ছাতারে। তবে বাগেরহাটে এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত ভ্যাদাটুনি (ভ্যাদা মানে কম বুদ্ধিসম্পন্ন নিরীহ মানুষ) নামে। ইংরেজি নাম অ্যাবোট’স ব্যাবলার। বৈজ্ঞানিক নাম Malacocincla abbotti। দৈর্ঘ্য ১৫-১৭ সেমি, ওজন ৩০ গ্রাম। গলা ও বুক সাদাটে। ঘাড়-মাথা-পিঠ লালচে বাদামি। সারা দেশেই দেখা মেলে। খুলনা-বাগেরহাটে প্রচুর সংখ্যায় আছে।

শরীফ খান, পাখি ও বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক