নিরীহ গাঙশালিক

গাঙশালিক। ২০১৮ সালে পদ্মার চরে।
ছবি: আদনান আজাদ

পদ্মা সেতুর তলা দিয়ে যখন পেরিয়ে যাচ্ছে লঞ্চটা, ছাদে দাঁড়ানো আমি তখন দেখতে পেলাম ১১টি গাঙশালিক। সেতুর একটি পিলারের গোড়ার চৌকো বেদিতে বসে ওরা নিজেদের ভেতর খুনসুটি করছে। নদীতে ঢেউ তেমন নেই, পানির উপরিভাগের ৬ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় ওরা আরামেই আমোদে মেতেছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তো বলতে গেলে প্রস্তুত, পাখিগুলো হয়তো পরখ করতে এসেছে, পিলার, সেতুর তলদেশ বা অন্য কোথাও ফাঁকফোকর খুঁজে পাওয়া যায় কি না! তা-ও আবার দূরে দূরে হলে চলবে না, কাছাকাছি হতে হবে। কেননা নদীর খাড়া পাড়, নতুন কাটা পুকুর-দিঘি-খালের পাড়সহ সেতু-কালভার্ট-পুল ইত্যাদির তলদেশের ফাঁকফোকরে কাছাকাছি-পাশাপাশি বা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাসা বানায় এই নিরীহ পাখিরা।

বড্ড সামাজিক পাখি, মায়াবী পাখি। খাড়া মাটির দেয়ালে গর্ত খুঁড়ে বাসা করে এরা। কলোনি বাসা। আর এদের ঝাঁকে ছাড়া দেখাই যায় না বলা যায়। বাসা বানানোর ক্ষেত্রে এরা খুবই হুঁশিয়ার। বিশেষ করে নদীর খাড়া পাড়ের ক্ষেত্রে। খুব হিসাব কষে এরা বাসা বানানোর পয়েন্টটা নির্বাচন করে। মাটি খুঁড়ে ভেতরের দিকে ঢোকে, পা ও বুক দিয়ে সেই ঝুরঝুরে মাটি গর্তের বাইরে এনে ফেলে। ৩ থেকে ৫ ফুট গভীর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এরা একটু ডানে-বাঁয়ে বা ওপরের দিকে এগিয়ে বড়সড় ডিমের চেম্বার বানায়। গর্তের প্রবেশমুখটা এমন মাপের যে সহজে যাতে সাপেরা গর্তে ঢুকে ডিম-ছানা গিলতে না পারে। সহজে যাতে খাড়া দেয়াল বেয়ে দাঁড়াশ সাপ বা অন্য সাপেরা গর্তমুখের নাগাল না পায়। নাগাল না পায় খ্যাঁকশিয়াল-ছোট বেজি-বড় বেজি-শিয়াল-খাটাশ ও বনবিড়ালেরা। শুধু ডিম ও পিচ্চি ছানা ছাড়া সাপের কবলে পড়ার আশঙ্কা একেবারেই নেই। তবে উড়ু উড়ু ছানারা যখন গর্তমুখে বসে খিদে ও বায়নার কান্না ছড়ায়, তখনই সাপ বাদে অন্যরা এসে ছানা নিতে পারে। দুর্দান্ত দর্শনীয় ডাইভ মেরে নেমে আসতে পারে তুখোড় শিকারি পাখি বাজ তুরমতী।

না, না, শত্রু দেখলেই মহা হইচই জুড়ে দিয়ে গাঙশালিকেরা দলবদ্ধভাবে শত্রুকে আক্রমণে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিতে খুবই পারদর্শী। গুইসাপকে পর্যন্ত হটিয়ে দেয়।

তা ছাড়া গাঙশালিকেরা দক্ষ আর্কিটেক্ট ও মাটিবিজ্ঞানী। ওদের গর্ত খুঁড়ে দেখলে বিস্মিত হতে হবে। গর্তটি শেষ করতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগে। এরা ডিম পাড়ে ৩ থেকে ৭টি। দুজনেই ডিমে তা দেয় পালা করে। ডিম ফুটে ছানা হয় ১৪-২১ দিনে। সব বাসার ছানাপোনারা যখন উড়তে শিখে যায়, তখন মা-বাবাদের কী যে আনন্দ হয়!

গাঙশালিকের ইংরেজি নাম ব্যাংক ময়না। বৈজ্ঞানিক নাম Acridotheres ginginianus। দৈর্ঘ্য ২১ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৮৫ গ্রাম।