পরমাণু কৌশল থেকে ৪৫ লাখ টন ফসল

  • বিনা উদ্ভাবিত ধানের জাত ২০ দেশে চাষ হচ্ছে

  • বন্যা, লবণাক্ত ও খরাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করছেন সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা

মাঠে গবেষণায় ব্যস্ত বিজ্ঞানী মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম।  ছবি: সংগৃহীত
মাঠে গবেষণায় ব্যস্ত বিজ্ঞানী মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

পরমাণু কৌশল কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৬০টি ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ফসলের ৮ শতাংশ এখন এসব জাত থেকেই আসছে। আর পরিমাণের দিক থেকে তা প্রায় ৪৫ লাখ টন।

বিভিন্ন জাতের এই ফসল গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে লবণাক্ততা, বন্যা ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিপদকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে কৃষককে সহায়তা করছে। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের পরমাণু শক্তিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) একটি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

কৃষিপ্রযুক্তির প্রথাগত ব্যবহারের পাশাপাশি কৃষিতে এই সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম। তিনি এককভাবে ১৩টি ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন। যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছেন ৭টি জাত। ধান ছাড়াও উন্নত আঁশযুক্ত পাট, শাক হিসেবে ব্যবহারযোগ্য পাট, টমেটো, মুগডালসহ বিভিন্ন জাতের ফসল রয়েছে ওই তালিকায়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) সূত্রে জানা গেছে, মির্জা মোফাজ্জল ইসলামের উদ্ভাবন করা লবণাক্তসহিষ্ণু ধানের জাত বিনা-৮ দেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ জমিতে চাষ হচ্ছে। ভারত, নেপাল, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ২০টি দেশে ধানের এই জাত রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া হয়েছে ও সেখানে চাষ হচ্ছে। সম্প্রতি ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিনা-৭, ৮, ১১ ও ১২ জাতটি সেসব দেশে চাষের জন্য নেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, সিয়েরালিওন ও মিয়ানমারে পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানী।

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষম ফসলের জাত হিসেবে বিনা উদ্ভাবিত জাতগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনারও জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিতভাবে এই জাত তাদের দেশে চাষের অনুমতি চাওয়া হচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে নানা ধরনের বিপদ বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এসব বিপদ সহ্য করতে পারে এমন ফসলের জাত উদ্ভাবন করে চলেছেন, যা বিশ্বে অনুকরণীয়। ২০১৪ সালে মির্জা মোফাজ্জল ইসলামকে পরমাণু কৃষি গবেষণায় আউট স্ট্যান্ডিং অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার দেয় আইএইএ ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও)। বিশ্বের আটটি দেশের বিজ্ঞানীরা ওই বছর পুরস্কারটি পান। বাংলাদেশ ছাড়াও পেরু, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম ওই পুরস্কার পেয়েছিল।

মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের কৃষকেরা ফসল উৎপাদন করে যাচ্ছেন। আমরা বিজ্ঞানীরা এসব প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সহনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কম জমিতে ও কম পানি দিয়ে বেশি নিরাপদ ফসল উদ্ভাবন। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

লবণাক্ত এলাকায় নতুন আশা
আইএইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। এর ফলে দেশটির উপকূলের ১০ লাখ একর জমিতে ফসল হয় না। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবে। বিনার উদ্ভাবন করা জাত এসব এলাকায় চাষ হচ্ছে। ফলে উপকূলের এসব মানুষ নিজের এলাকায় চাষবাস করতে পারবে। সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, লবণাক্তসহিষ্ণু ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত চাষ হলে দেশে অতিরিক্ত ৬০ লাখ টন ধানের উৎপাদন হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিনা-৮ জাতের ধানের উৎপাদন দেশের উপকূলীয় এলাকায় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এত দিন লবণাক্তসহিষ্ণু ধানের জাত হিসেবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) ব্রি ধান-৪৭, ব্রি-৬১ ও ব্রি-৬৭ চাষ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে বিনা-৭ ও ৮ জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশেষ করে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটে এই জাতের চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।

কম পানিতেও ফলন দেয়
বন্যা মৌসুমে দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল বন্যা। বেশির ভাগ ধান পানির নিচে তিন থেকে পাঁচ দিন ডুবে থাকলে ফসল নষ্ট হয়ে যেত ও ফলন কমে যেত। বিনা উদ্ভাবিত বিনা-৭ ও ২০১৮ সালে উদ্ভাবন করা বিনা-১২ বন্যার বিপদ থেকে ফসল রক্ষা করছে। সর্বোচ্চ ২৪ দিন এটি পানির নিচে ডুবে থাকলেও নষ্ট হয় না। দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের কৃষকের কাছে এই জাত খুব দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

দেশের আমনের জাতগুলো প্রতি একরে তিন থেকে চার টন উৎপাদিত হয়। বিনা উদ্ভাবিত বিনা-১৭ জাত সাত টন করে ফলন দিচ্ছে। দেশের আমনের উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনেও বিনা উদ্ভাবিত এই জাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে।

২০১১ সালে আফ্রিকার দেশ উগান্ডা থেকে নেরিকা নামের একটি ফসলের জাত নিয়ে আসা হয়। খরাসহিষ্ণু এই জাত নানা কারণে দেশে তেমন জনপ্রিয় হয়নি। বিনার বিজ্ঞানীরা নেরিকা-১০ জাতটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের আগস্টে তাঁরা নেরিকা থেকে বিনা ২১ জাতের একটি জাত উদ্ভাবন করেন। এটি অন্য ধানের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম পানিতে চাষ করা যায়। একই সঙ্গে এতে ইউরিয়া সারের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কম লাগে।

আইএইএ এবং এফএওর যৌথ পরমাণু কৃষি গবেষণা বিভাগের প্ল্যান্ট ব্রিডিং ও জেনেটিকস বিভাগের প্রধান এলজুপচো জানকুলফি প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিপদ বাংলাদেশের সামনে চলে এসেছে, তা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বিনার এসব জাত হতে পারে বাংলাদেশের অস্ত্র।