পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখর জবই বিল

নওগাঁ সাপাহার উপজেলার জবই বিলে ভিড় করেছে হাজারো অতিথি পাখি। গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা।  ছবি: প্রথম আলো
নওগাঁ সাপাহার উপজেলার জবই বিলে ভিড় করেছে হাজারো অতিথি পাখি। গত মঙ্গলবার দুপুরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

বিলের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন তরুণ প্রদীপ কুমার। তাঁর চোখের সামনে হাজারো বালিহাঁস ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে। তরুণটির চোখেমুখে যেন অপার বিস্ময়। শুধু প্রদীপই নন, তাঁর মতো আরও ১০-১২ জনকে এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করতে দেখা গেল।

নওগাঁ শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে সাপাহার উপজেলার জবই বিল এলাকায় এ দৃশ্য দেখা গেল গত মঙ্গলবার। জানা গেল, গত নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে নানা জাতের পরিযায়ী পাখির কলরবে মুখর হতে থাকে বিলটি।

সাইবেরিয়াসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা বালিহাঁসের ঝাঁক উড়তে দেখা গেল আকাশজুড়ে। পাখির কলরবে মুখর চারপাশ। জলাশয়ে খাবারের খোঁজে বিচরণ করছে শত শত পাখি। জলাশয়ে তো রয়েছেই, আশপাশের কৃষিজমিতে বিভিন্ন ফসলের খেত, গাছের ডালপালা-শাখা—সর্বত্র এই পাখিদের বিচরণ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাঁচ-ছয় বছর ধরে জায়গাটিতে পরিযায়ী পাখি আসছে। বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির মধ্যে হাঁসজাতীয় পাখির সংখ্যাই বেশি। পরিযায়ী পাখি ছাড়াও দেশি জাতের শামুকখোল, পানকৌড়ি, ছন্নিহাঁস, বক পাখি বিল এলাকা মুখর করে রেখেছে।

সাপাহার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুল কবির এসেছিলেন পাখি দেখতে। তিনি বলেন, ‘নিজের এলাকায় পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম দেখে অনেক গর্ব হয়। দূরদূরান্তের মানুষ এখানে আসে পাখি দেখতে। সময় পেলেই ছুটে আসি। এখানে এসে হাজারো পাখির বিচরণ দেখে মন উৎফুল্ল হয়ে যায়।’

সাপাহার উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা শিরন্টি ইউনিয়নে অবস্থিত এই বিল। জবই বিলের জলমহালের আয়তন ৪০৩ হেক্টর। ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল বাকী বলেন, পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই বিলে পরিযায়ী পাখি আসছে। শীতের শুরুতে এখানে পাখিরা আসতে শুরু করে। শুরুতে স্থানীয় লোকজন পাখি শিকার করতেন। কিন্তু প্রশাসন ও স্থানীয় কিছু সচেতন মানুষের তৎপরতায় পাখি শিকার অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কেউ প্রকাশ্যে পাখি শিকার করতে পারেন না। এই বিল ঘিরে স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের সচেতন কয়েকজন তরুণ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটি নামের একটি কমিটি গঠন করেন। শিকারিরা যেন পাখি শিকার করতে না পারেন, সেদিকে নজরদারি করেন কমিটির সদস্যরা।

জবই বিলঘেঁষা গ্রাম কলমুডাঙ্গা। এই গ্রামের বাসিন্দা আবদুল বারী, ময়নুল হক ও বেলাল হোসেন জানান, পাখিরা জলাশয় ছাড়াও গ্রামের গাছের ডালপালা, বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় ওড়াউড়ি করে। গাছের ফল খেয়ে ফেলে। এরপরও গ্রামের মানুষ পাখিদের কোনো সমস্যা করে না।

জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সোহানুর রহমান বলেন, শুরুতে এলাকার কিছু মানুষ জবই বিলে আসা পাখিদের অবাধে শিকার করতেন। কিন্তু সচেতন মানুষ একজোট হয়ে এর প্রতিবাদ করায় এবং প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে এই বিলে পাখি শিকার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন পাখিরা বিলটিতে বেশ নিরাপদে আছে।

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী পরিযায়ী পাখি হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

সাপাহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কল্যাণ চৌধুরী বলেন, জলাশয়ে আসা পরিযায়ী পাখিদের কেউ যাতে শিকার করতে না পারে, বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নজরে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন করা হচ্ছে। পাখিদের বিচরণ যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে প্রশাসন অত্যন্ত কঠোর। তিনি বলেন, বিলপাড়ে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য বিলের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কের দুই পাশে বসার স্থান করে দেওয়া হয়েছে। এই এলাকার সাংসদ ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জবই বিলকে একটি পর্যটনকেন্দ্রে রূপ দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে এই বিলকে আরও দৃষ্টিনন্দন করা হবে।