পানিবন্দী জীবনে বিব্রতকর সমস্যা

বন্যায় চারদিকে পানি আর পানি। মাথায় কাঁঠাল নিয়ে বুকপানি ভেঙে বাড়ি ফিরছেন রাবেয়া বেগম। গতকাল সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌর শহরের আজিমনগর এলাকায়।  ছবি: আব্দুল আজিজ
বন্যায় চারদিকে পানি আর পানি। মাথায় কাঁঠাল নিয়ে বুকপানি ভেঙে বাড়ি ফিরছেন রাবেয়া বেগম। গতকাল সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌর শহরের আজিমনগর এলাকায়। ছবি: আব্দুল আজিজ

তিস্তাপারের জেলা লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার গড্ডিমারী ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ প্রায় এক মাস ধরে পানিবন্দী। যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি, তাঁরা ঘরের মধ্যে মাচা তৈরি করে কোনো রকমে দিন পার করছেন। বন্যার পানির তোড়ে এই ইউনিয়নের বেশির ভাগ বাড়ির শৌচাগার (টয়লেট) ভেসে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে শৌচকর্মের জন্য ঘরের সঙ্গে থাকা ভেলা বা নৌকায় করে এক ঘণ্টা দূরের পথ পাড়ি দিতে হয় তাঁদের। কোনো উঁচু স্থানে গিয়ে শৌচকর্ম করে বাড়িতে আসা–যাওয়া বাবদ ঘণ্টা দুয়েক লেগে যাচ্ছে।

শুধু গড্ডিমারী ইউনিয়নের মানুষেরাই নন, বিব্রতকর এ সমস্যায় পড়ছেন বন্যায় পানিবন্দী জীবন কাটানো বেশির ভাগ এলাকার মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকার পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাকে নিয়ে দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বন্যাকবলিত ৯০ শতাংশ এলাকার পানি সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আর ৯৩ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এর ফলে ৬৮ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারছে না। ফলে নানা রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রতিবেদন তৈরির কাজে যুক্ত একটি বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত ৮১ হাজার ৭৯টি ল্যাট্রিন (শৌচাগার) পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে বন্যার্ত মানুষের জন্য কিছু মোবাইল টয়লেট (ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার) দেওয়া যেতে পারে। আর কিছুটা ডুবে যাওয়া পাকা শৌচাগারগুলোর দুই পাশে বালুর বস্তা দিয়ে এটি ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি বাংলাদেশেই পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। সরকার এই উদ্যোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, যেখানে বন্যার্ত মানুষের আশ্রয় নেবে তার অন্তত ৩০ ফুট দূরে অস্থায়ী ল্যাট্রিন স্থাপন করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রের আশপাশে কেউ যাতে শৌচকর্ম নিশ্চিত করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় টিউবওয়েল ও শৌচাগারের অভাবে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য প্রাথমিক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম অনুসরণ করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে যেসব অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেখানেও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে নারী এবং শিশুরা তাদের সম্মান ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা আশ্রয়কেন্দ্রে নিশ্চিত করতে পারছেন না। বন্যার্ত এলাকায় দ্রুত নিরাপদ পানি পৌঁছে দেওয়া, হাত ধোয়ার সাবানসহ অন্যান্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

>

এখন পর্যন্ত ৩১ জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে
৬৮ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারছে না

বন্যাকবলিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা সদর থেকে গতকাল নৌকায় করে প্রায় তিন ঘণ্টা দূরের হাটবাড়ির চরে যান প্রথম আলোর বগুড়া প্রতিনিধি। সেখানে গিয়ে দেখেন গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে বুকসমান পানি। এর মধ্যেই ঘরের ভেতরে মাচা করে থাকছে লোকজন। এখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নৌকাতেই গোসল, টয়লেট ও রান্নাবান্না সারেন। গ্রামের বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম বলেন, বয়স্ক ও শিশুরা খুব বিপদে আছে। শৌচাগার সব ডুবে যাওয়ায় তাদের পক্ষে দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আবার গোসলের জন্য পানি নেই। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন থেকে গতকাল পর্যন্ত বন্যা ও পানিবাহিত রোগে ৯ হাজার ৫০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ হাজার ২৩৯ জন পানিবাহিত ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় একজন মারাও গেছেন। আর সব মিলিয়ে বন্যায় মারা গেছেন ১১১ জন। এর মধ্যে ৮৯ জনই পানিতে ডুবে মারা গেছেন।

৩১ জেলায় বন্যা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ৩১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব জেলায় এ পর্যন্ত ১২ হাজার ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম তদারকির জন্য ছয়টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো উপজেলা, ইউনিয়ন ও মাঠপর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম তদারক করবে। কমিটিগুলোকে ২১ দিনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

গতকাল শনিবার মন্ত্রণালয় থেকে অনলাইনে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এসব তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে চাল ছাড়াও ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ১ লাখ ২১ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট, গোখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, শিশুখাদ্য কেনার জন্য ৭০ লাখ টাকা, ৩০০ বান্ডিল ঢেউটিন এবং গৃহমঞ্জুরি বাবদ ৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে যেকোনো ব্যক্তি ত্রাণসহায়তা চাইলে প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁকে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।

বন্যাকবলিত জেলা

ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ।

এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, রাজবাড়ী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও নওগাঁ জেলায় আগামী দুই দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।