পানির বৈষম্য শহরে-গ্রামে, ধনী-গরিবে

দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোর মানুষকে সুপেয় পানির জন্য কষ্ট করতে হয়। ফাইল ছবি
দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোর মানুষকে সুপেয় পানির জন্য কষ্ট করতে হয়। ফাইল ছবি

শুকনো মৌসুম এলেই আতেইমা মারমার (৪৭) চিন্তা বেড়ে যায়। এ চিন্তা পানি নিয়ে। স্বামী আর চার সন্তান নিয়ে সংসার এ পাহাড়ি নারীর। তাঁর বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা গ্রামে। পাহাড়ি এ গ্রামটির অবস্থান উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে। শীতের এই সময়ে পানির চাহিদা কম থাকলেও পানির প্রধান উৎস ছড়াগুলো এ সময়টায় শুকাতে শুরু করে।

পাথুরে মাটির এ গ্রামে রিংওয়েল (পাতকুয়া) বসিয়েও কাজ হয় না। তাই ভরসা, ছড়ার মাটি খুঁড়ে পানির সন্ধান। আর এ কাজে আতাইমার দিনে অন্তত দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। বার তিনেক তাঁকে খাওয়ার পানির সন্ধানে বের হতে হয়।

দেশের পাহাড় বা উপকূলের মতো দুর্গম অঞ্চলগুলোর মানুষকে সুপেয় পানির জন্য আতাইমার মতো কষ্ট করতে হয়। পানির জন্য এসব মানুষকে যে সময় বা অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা ঢাকা বা অন্যান্য শহরবাসী মানুষের চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি।

পানির সুযোগের ক্ষেত্রে শহর-গ্রাম ও মানুষে মানুষে বৈষম্য নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের হেড অব প্রোগ্রামস আফতাব ওপেল। অর্থনীতির একটি প্রত্যয় দিয়ে গ্রাম ও শহরের পানি-বৈষম্যের এই চিত্র তিনি তুলে ধরেন। সেই প্রত্যয়টি হলো, সুযোগ পরি ব্যয় (opportunity cost)। এর মানে হলো, একটি কাজ করতে যে পরিমাণ সময় ব্যয় হয়, অন্য কাজ করলে তাতে কী পরিমাণ ব্যয় হতো, এর আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা।

আতাইমা মারমা পানি নিয়ে দিনে অন্ত দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। এখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও একজন দিনমজুরের মজুরি দিনে ৪০০ টাকার মতো। আট ঘণ্টা দিনমজুরি করলে ৪০০ টাকা যদি পাওয়া যায়, তবে প্রতি ঘণ্টায় তার সুযোগ পরি ব্যয় ৫০ টাকা। আর দেড় ঘণ্টায় ৭৫ টাকা। তিনবারে আতাইমা ৩০ লিটার পানি আনেন বলে জানান। অর্থাৎ, ৩০ লিটার পানির জন্য পাহাড়ি এই নারীর ব্যয় ৭৫ টাকা।

ঢাকা ওয়াসা এলাকায় থাকা একটি পরিবারকে এক হাজার লিটার পানির জন্য ১১ টাকা ৫৭ পয়সা দিতে হয়। আতাইমার মতো দূর পাহাড়ের আর্থিকভাবে নিম্ন আয়ের মানুষকে ৩০ লিটার পানির জন্য দিতে হয় ৭৫ টাকা।

সুপেয় পানির সংকট প্রকট দেশের উপকূলীয় অঞ্চলেও
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা সদরে থাকেন রণজিৎ মণ্ডল। পেশায় শিক্ষক রণজিৎকে প্রতি সপ্তাহে ১৫০ লিটার পানি সরবরাহ করেন এক ব্যক্তি। কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে পানি এনে রণজিৎকে দেন ওই ব্যক্তি। এ পানি দিয়ে রণজিতের পাঁচ সদস্যের পরিবারে মোটামুটি পুরো সপ্তাহের খাওয়ার পানির চাহিদা মেটে। এ জন্য রণজিতের পরিবারকে ব্যয় করতে হয় ১৩০ টাকা।

সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন পানির ব্যবসায় একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেক মানুষ এতে যুক্ত হচ্ছেন।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় নীতির সমস্ত লক্ষ্য কেন্দ্রমুখী বা সুনির্দিষ্টভাবে বললে রাজধানীমুখী। এর ফলেই এই বৈষম্য।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা পানির যে বৈষম্যের কথা বললেন, তা শুধু কেন্দ্র বা রাজধানীর সঙ্গে পাহাড় বা উপকূলের মতো প্রত্যন্ত এলাকারই নয়। খোদ রাজধানীর মধ্যেও এই বৈষম্য আছে।

গ্রাহকদের কাছে কম দামে খাওয়ার পানি বিক্রি করতে পানির পাম্প হাউসের পাশে এটিএম বুথ বসিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসা সূত্র জানায়, বস্তিবাসী, সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি—যাঁদের বৈধ সংযোগ নেই, এমনকি পথচারীদের নিরাপদ পানি দিতে মূলত এটিএম সেবা চালু করা হয়। প্রতি লিটারের দাম ৪০ পয়সা।

আফতাব ওপেল বলেন, ‘ওয়াসা বলছে, দরিদ্র মানুষকে বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতেই তাদের এই উদ্যোগ। কিন্তু এর দাম ৪০ পয়সা কেন। যেখানে হাজার লিটার পানির দাম সাড়ে ১১টাকা, সেখানে এই দামও নিঃসন্দেহে একটি বৈষম্য।’

গবেষণায় দেখা গেছে, পানি ও স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দও কেন্দ্রমুখী। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড, ইউনিসেফ ও পিপিআরসির এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দের ৬০ ভাগের বেশি চলে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী নগরের চার ওয়াসায়। ছোট শহর ও গ্রামে থাকা মোট জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ মানুষের জন্য বরাদ্দ ২০ ভাগেরও কম। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে আবার রাজনৈতিক বিবেচনাও প্রাধান্য পায়।

চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন অর্থবছরে চার ওয়াসা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পেয়েছে। এটি পানি ও স্যানিটেশন খাতে দেশের মোট বরাদ্দের ৬৬ শতাংশের বেশি। এই সময়ে বাকি মেট্রোপলিটন শহরগুলো পেয়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশের অবশিষ্ট পৌরসভা ও গ্রামের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।

হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘কেন্দ্রমুখী নীতির জন্য বাজেটে মনোপলি তৈরি হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হলো, বাজেট বরাদ্দে বৈষম্য কমানো।’

কিন্তু সরকার এ নিয়ে কী ভাবছে?

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা বাস্তবতা যে বাংলাদেশের ভৌগোলিকভাবে প্রতিকূল এলাকায় সুযোগ-সুবিধা কম। উপকূল বা পাহাড়ে পানির যে সমস্যা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এ সমস্যা সমাধানে এবং বৈষম্য নিরসনে আমরা কাজ করছি।’