প্রকৃতির লীলাভূমি চলনবিল

প্রবাদ আছে, ‘বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম।’ চলনবিল—যার নাম শুনলেই গা ছমছম করে ওঠে থইথই জলে উথালপাতাল ঢেউয়ের কথা ভেবে। তবে চলনের এ রূপ বর্ষার। ষড়্ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা যায় চলনবিলকে। বর্ষায় সাগরের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ংকর রূপ ধরে এ বিল, শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে ম–ম করে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের নিধুয়া পাথার এবং গ্রীষ্মে চলনের রূপ রুক্ষ। যেকোনো ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ।

চলনবিলে এ সময় দেখা যাবে মাছ ধরার ধুম। ছবি: হাসান মাহমুদ
চলনবিলে এ সময় দেখা যাবে মাছ ধরার ধুম। ছবি: হাসান মাহমুদ

রূপবদলের এই বৈচিত্র্যে শরতের চলনবিল এক ভিন্ন জগৎ। বর্ষার চলনবিলের রুদ্র মূর্তি এখন শান্ত, জলরাশি স্থির। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নানা রঙের ফুল, হরেক পাখির কলরব। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ সাজ। তাই চলনবিলে নিরাপদে নৌকায় ভ্রমণ করার জন্য শরৎই শ্রেষ্ঠ সময়। নাটোর, পাবনা কিংবা সিরাজগঞ্জ—যেকোনো এক জেলা থেকে নৌকা নিয়ে ভেসে ভেসে আপনি যেতে পারেন বিলের গভীর প্রদেশে। একের পর এক গ্রাম, বিল, নদী নৌকায় ভেসে পার হতে হতে ধরে রাখতে পারেন জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। নৌকা ভাড়া করে প্রয়োজনীয় লাইফ জ্যাকেট এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে আপনি দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে পারেন চলনের স্বচ্ছ জলে। চাইলে মাঝিদের বলে রান্নাবান্নার আয়োজনও করতে পারেন নৌকায়। পুরোটা না হলেও খোলা হাওয়ায় বিলের একটা বড় অংশ ঘুরে বেড়ানো যাবে এক দিনে। বর্ষার মতো এই শরতে আপনার আর ভ্রম জাগবে না যে আপনি সমুদ্রে আছেন, নাকি কোনো বিলে আছেন। এখন জায়গায় জায়গায় দেখতে পাবেন ধানখেত, দেখতে পাবেন চাষিদের পাট ধোয়া কিংবা মাছ শিকার। এসব দেখতে দেখতে আপনি মাঝিদের কাছে গল্প শুনতে পাবেন—এ বিলের বুকে প্রমোদতরি ভাসিয়ে একসময় রাজা-বাদশারা ক্লান্তি ঝেড়েছেন। পর্যটকেরা চলনবিলের বিশালতা দেখে অভিভূত হয়েছেন। লেখকেরা রচনা করেছেন বিভিন্ন কাহিনি। চলনবিলের মাছে ভোজ হয়েছে অভিজাত বাড়িতে। কালের বিবর্তে এসবের অনেকটাই এখন বিবর্ণ। বিলের তলদেশে পলি জমে ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এর বিশালতা।

চলনের শান্ত জলে দেখা যাবে ফুটন্ত শাপলা। ছবি: হাসান মাহমুদ
চলনের শান্ত জলে দেখা যাবে ফুটন্ত শাপলা। ছবি: হাসান মাহমুদ

বিলের বিশালতা
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের ওপরে। এরপর ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। আপনি কিছুটা ভিরমি খেতে পারেন যখন শুনবেন চলনবিলে রয়েছে বিভিন্ন নামের অনেক বিল! জানিয়ে রাখা ভালো, বিস্তীর্ণ চলনবিলের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন নামে ১ হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল। প্রধান ৩৯টি বিলসহ মোট ৫০টির বেশি বড় বড় বিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে চলনবিল। এই বিলগুলো চলনকে বিশালতা দিয়েছে। নানা রূপে সাজিয়েছে বিলের সৌন্দর্যকে। বিলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছয়আনি বিল, বাঁইড়ার বিল, সাধুগাড়ি বিল, সাঁতৈল বিল, কুড়ালিয়া বিল, ঝাকড়ার বিল, কচুগাড়ী বিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ি বিল, চেচুয়া বিল, টেঙ্গরগাড়ি বিল, খোলার বিল, কুমীরাগাড়ি বিল, খৈগাড়ি বিল, বৃগরিলা বিল, দিগদাড়িয়া বিল, খুলুগাড়ি বিল, কচিয়ারবিল, ধলার বিল, ধরইল বিল, বড়বিলা, বালোয়া বিল, আমদাকুরি বিল, বাঙ্গাজালি বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরী বিল, রঘু কদমা বিল, কুমিরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়ি বিল, রহুয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড় বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রাম বিল, বেরোল বিল, কচিয়ার বিল, কাশিয়ার বিল, কাতল বিল, বাঘ মারা বিল, চিরল বিল, ডিকশী বিল, রুখলি ডাঙা বিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়া বিল, আইড়মারি বিল, কৈখোলা বিল, কানচগাড়ি বিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গা বিল, মেরিগাছা বিল, খলিশাগাড়ির বিল প্রভৃতি।

সব ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ। ছবি: হাসান মাহমুদ
সব ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ। ছবি: হাসান মাহমুদ

শুধু কি বিল?
বিলের মধ্যে যখন আপনি নৌকাভ্রমণে ব্যস্ত থাকবেন, তখন শুনতে পাবেন, আপনি একটি নদীও পার হচ্ছেন। বেশ কিছু নদ-নদী ও খাল আঁকাবাঁকা জলরাশিতে তৈরি করেছে চলনবিলের আলাদা সৌন্দর্য। চলনবিলে রয়েছে ৪ হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ২২টি খাল ও অসংখ্য পুকুর। এসব নদ–নদী ও খালগুলোর মধ্যে রয়েছে আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বান গঙ্গা, তেলকুপি (মরা আত্রাই), নবী হাজির জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুরা খাল, দোবিলা খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ি-ছারুখালি খাল, বিল সূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী ও জানিগাছার জোলা।

চলনবিলকে একসময় বলা হতো ‘মাছেদের বাড়ি’। দেশি প্রজাতির নানা মাছে এই বিল ভরপুর ছিল। বিলের মাছ ট্রেনযোগে যেত বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখানকার অভিজাত মানুষেরা চলনবিলের মাছ দিয়ে ভোজে মাততেন। এখন তেমনটি না থাকলে বহু প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলবে বিলে। এর মধ্যে রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, শিং, মাগুর, কই, শোল, গজার, টাকি, বাইম, পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, টাটকিনি, ভেদা ও চাঁদা উল্লেখযোগ্য। বিলের যেখানেই পানি আছে, সেখানেই চোখে পড়বে মাছ ধরার ধুম। সুতিজাল, ভেশাল, খাঁড়া জাল, দোয়ার, চাঁই, বড়শিসহ বিভিন্ন মাছ ধরার যন্ত্র নিয়ে মেতে আছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ।

শরতের চলনবিলের রূপবিকাশে আরেকটি বৈচিত্র্য হচ্ছে ফুল—শাপলা, পদ্ম, কচুরিপানা তো আছেই। আর নানা রঙের বুনো ফুল দেখা যাবে বিলজুড়ে। বিভিন্ন জলজ গাছ ও ধানের আইলে দেখা মিলবে হরেক রকম বুনো ফুল। এ ছাড়া শরতের শান্ত চলনে দেখা মিলবে হরেক পাখির। রঙিন মাছরাঙার শিকার ধরা তো আছেই। শরতের এই সময়টাতে মিলবে সবুজ ধানের খেতে সাদা বক আর জলে পানকৌড়িদের ডুবসাঁতার খেলা। এ ছাড়া শালিক, ডাহুক, ফিঙে, দোয়েল তো আছেই।

চলনবিল। পাবনা অংশ। ছবি: হাসান মাহমুদ
চলনবিল। পাবনা অংশ। ছবি: হাসান মাহমুদ

বিশাল এই বিলকে কেন চলনবিল নামে ডাকা হয়, এর সঠিক উত্তর মেলেনি আজও। কথিত আছে, দুই হাজার বছর আগেও চলনবিল নামের অস্তিত্ব ছিল না। এই অঞ্চল ছিল তখন সমুদ্রগর্ভে। কালের আবর্তে সমুদ্র সরে যায় আরও দক্ষিণে। ব্রিটিশ গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে, সমুদ্র সরে যাওয়ার পর তার স্মৃতি ধরে রেখেছে চলনবিল। অন্যান্য বিলের মতো এই বিল স্থির নয়। হয়তো নদীর মতো এতে স্রোত ছিল বলেই এর নাম হয়েছিল চলনবিল।

‘ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ নামক বই থেকে জানা যায়, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া; নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই; সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া; পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল শেরপুর মিলেই বিশাল আয়তনের চলনবিল। একসময় এর পুরোটাই ছিল বিস্তীর্ণ। ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের পর উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণ—তিন অংশে চলনবিল বিভক্ত হয়। বর্তমানে চলনবিলে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া; পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন, আটটি পৌরসভা ও ১ হাজার ৬০০টি গ্রাম রয়েছে। পুরো অঞ্চলের লোকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি। এ কারণে বিশাল বিল, জলরাশি, সবুজ ধানখেত, ফুল, পাখির পাশাপাশি চলনবিলে বেড়াতে গেলে পরিচয় হবে কিছু দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে। দেখা পাবেন দেশের বড় গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম কলম গ্রামেরও, যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাবনার চাটমোহরে শাহি মসজিদ, জগন্নাথমন্দির; ফরিদপুরের বনওয়ারী নগর জমিদারবাড়ি; সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দেখা যাবে রাধাগোবিন্দমন্দির, রশিকমন্দির, শিবমন্দির, বড় কুঞ্জবন দিঘি, উলিপুর দিঘি, মথুরা দিঘি, মাকরসন দিঘি। তাড়াশের কাছে পিঠে বিনসারা গ্রাম। সেখানে গিয়ে দেখা মিলবে কিংবদন্তি বেহুলা সুন্দরীর বাবা বাছো বানিয়া ওরফে সায় সওদাগরের বসতভিটা ‘জিয়ন কূপ’। এ ছাড়া নাটোরের গুরুদাসপুরে খুবজিপুর গ্রামে দেখা যাবে চলনবিল জাদুঘর। এখানে পাবেন চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় জিনিসপত্র।

চলছে শরৎকাল। শান্ত জলরাশি, তাজা অক্সিজেনে ভরপুর নির্মল প্রকৃতি আর প্রাচীন নিদর্শন দেখতে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিল থেকে।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা অথবা পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর। সবখানেই বাসযোগে আসা যাবে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে আসলে চাটমোহর অথবা ভাঙ্গুরার বড়াল ব্রিজ স্টেশনে নেমে চলনবিল ঘোরা যাবে। দেশের অন্য যেকোনো স্থান থেকেই খুব সহজে বাসে আসা যাবে সিরাজগঞ্জের কাছিকাটা। কাছিকাটা নামলে সেখান থেকে ছোট–বড় নৌকায় চলনবিল ঘোরা যাবে। অন্যদিকে ব্যাটারিচালিত নৌকায় বিলের রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়ানো যাবে। কাছিকাটা থেকে আট কিলোমিটার দূরে চাটমোহর বাজার। এখানে এলে মিলবে সুস্বাদু রসমালাই।