ফিরে আসছে বন কাঁকরোল

পাকার পর বন কাঁকরোল। প্রায় বিলুপ্ত হতে যাওয়া জাতটি খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী বনে
ছবি: সংগৃহীত

একেকটির ওজন আধা কেজির মতো। কোনো কোনোটি এর চেয়েও বড় হয়। বাজারে যে কাঁকরোল পাওয়া যায়, দেখতে অবশ্য সে রকমই। রকমফের কেবল ওজন আর পুষ্টিগুণে।

বন কাঁকরোল হিসেবে পরিচিত এই জাত দেশি জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড়। প্রায় বিলুপ্ত হতে যাওয়া জাতটিকে খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক, চকরিয়া এলাকার ফাঁসিয়াখালী বনভূমিতে। এটি সংরক্ষণ ও জাত উন্নয়নেরও উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁরা।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২২ জাতের কাঁকরোল সংরক্ষণ করেছে। এর মধ্য থেকে তিনটি উন্নত জাত উদ্ভাবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের কাছে দেশি ওই বড় জাতের কাঁকরোল নেই। বাংলাদেশের উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল হারবেরিয়ামে এই কাঁকরোলের বীজ সংরক্ষণ করা থাকলেও এখন পর্যন্ত জাত উন্নয়নে কোনো কাজ হয়নি।

ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরকার নাসিরউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন কাঁকরোলের বীজ আমাদের কাছে আছে। দেশি এই জাতের সঙ্গে বাজারের প্রচলিত জাতটির সংকরায়ণ করলে অনেক বড় ও পুষ্টিকর জাতের কাঁকরোলের জাত উদ্ভাবন সম্ভব।’

বন কাঁকরোলের বীজ রোপণ করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বাগানে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন তা ফাঁসিয়াখালী বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছেন। বীজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন এটিই সেই বন কাঁকরোল।

কেবল আকৃতিতে বড় বলেই একে অবশ্য বিখ্যাত বলা হচ্ছে না। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ওই কাঁকরোল রীতিমতো উৎসব অনুষ্ঠানে খাওয়া হয়। ভিয়েতনামে বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-কনেকে রোগমুক্তির দাওয়াই হিসেবে এই সবজি রান্না করে খাওয়ানো হয়। ফিলিপাইন, চীন, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় এটি বহুল প্রচলিত বুনো সবজি হিসেবে জনপ্রিয়। বিশ্বের নামীদামি একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে, এই সবজি ঔষধি ও পুষ্টিগুণে খুবই সমৃদ্ধ। Momordica cochinchinensis বৈজ্ঞানিক নামে পরিচিত ওই সবজির ঔষধি গুণাগুণ নিয়ে নিত্যনতুন গবেষণাও হচ্ছে।

অধ্যাপক জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটির বীজ থেকে চারা তৈরির কাজ শুরু করেছি। যে কেউ এটি সংগ্রহ করে চাষাবাদ শুরু করতে পারেন। এমনকি বাণিজ্যিকভাবে চাষের উদ্যোগ নিলেও এই গুরুত্বপূর্ণ সবজিটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ পুষ্টি চাহিদা ও ওষুধ হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এর আগে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন ২০১২ সালে সিলেট থেকে এর চারা সংগ্রহ করেছিলেন। কার্জন হলের বাগানে তা রোপণও করেছিলেন। পরে অবকাঠামো নির্মাণ ও বাগান উন্নয়নের নামে সেই চারাগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। পরে সারা দেশে ঔষধি বৃক্ষের ওপরে একটি জরিপ করতে গিয়ে বান্দরবানে তাঁরা এটি খুঁজে পান।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বন কাঁকরোলকে খুবই উচ্চমানের পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সবজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগ নিয়ন্ত্রণে এটি বেশ কার্যকর হিসেবে পরিচিত।

প্রাণবৈচিত্র্য গবেষক পাভেল পার্থ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বন কাঁকরোল একসময় বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকাতেই প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত। কুড়িয়ে পাওয়া সবজি হিসেবে এটি বেশ জনপ্রিয়। তবে দ্রুত নগরায়ণ ও বাণিজ্যিক কৃষির কারণে এটি বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এটি শুধু মানুষের নয়, অন্য প্রাণীদের খাবার হিসেবেও বেশ জরুরি। তাই এই সবজি স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে সংরক্ষণ করা উচিত।