বড় বন্যার আশঙ্কা, প্রস্তুতি কম

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোয়ালীপাড়া গ্রাম। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র ছুটছে লোকজন। ছবিটি গতকাল দোয়ালীপাড়া-চিকলী সড়কের মাজারের কাছ থেকে তোলা l রহিদুল মিয়া
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোয়ালীপাড়া গ্রাম। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র ছুটছে লোকজন। ছবিটি গতকাল দোয়ালীপাড়া-চিকলী সড়কের মাজারের কাছ থেকে তোলা l রহিদুল মিয়া

এ বছর মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই তিন বছরই বাংলাদেশে বড় বন্যা হয়েছে। তাই এ বছরও বড় বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন আবহাওয়াবিদ ও গবেষক।

ইতিমধ্যে দেশের ২৬ জেলা বন্যার কবলে পড়লেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো এখন পর্যন্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারেনি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে না, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানি। স্বল্পতা রয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, টিউবওয়েল ও শৌচাগারের। মাত্র সাতটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে ১ হাজার ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য। সর্বোপরি কাজের ক্ষেত্রে এক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেক মন্ত্রণালয়ের নেই সমন্বয়।

দুর্যোগ, খাদ্য, কৃষি, স্বাস্থ্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের বন্যার ভয়াবহতা আগের বন্যাগুলোকে
ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক

পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খাদ্য এবং দুর্যোগ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছি। বাঁধের ভাঙন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি। ত্রাণ ঠিকমতো যাচ্ছে কি না তা তদারক করতে বলা হয়েছে। আমরা আরও বলেছি, বন্যাকবলিত এলাকায় যাতে পানির সংকট না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয় করে কাজ করতে বলা হয়েছে।’

দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি

দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৯ থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বন্যায় ৩৩ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৭ হেক্টর। তবে এদের মধ্য অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্তকে সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের। এদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল এবং পৌনে ২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভিজিএফ খাতে খাদ্যশস্য বরাদ্দ আপাতত স্থগিত হয়েছে। বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। সুতরাং চালের সংকট হবে না।

বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতির বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিবের চলতি দায়িত্বে থাকা মো. গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সহায়তা যাতে যায় সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ ৫২ হাজার পরিবার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৩৭ জন। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৯টি। এগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৪ লাখ ১১ হাজার।

বড় বন্যার আশঙ্কা কেন

আবহাওয়াবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, এবারের মৌসুমি বায়ুর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গতিপ্রকৃতি ও প্রবাহের উৎসস্থল ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে প্রবাহিত শক্তিশালী বায়ু দুই পথে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর একটি পথ বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (সাধারণত টেকনাফ) থেকে স্থলভাগে প্রবেশের। অন্য পথটি সোমালিয়ার কাছ থেকে আরব সাগরের ওপর দিয়ে ভারতে প্রবেশের।

সাধারণভাবে জুনের প্রথম সপ্তাহে এই দুই পথে মৌসুমি বায়ু প্রবেশের পরই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মৌসুমি বায়ু যতই বিস্তৃত হয়, ততই বাড়তে থাকে বৃষ্টিপাতের অঞ্চল। এ বছর এই মৌসুমি বায়ুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দুই পথেই প্রবাহ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুটি প্রবাহ একত্র হয়ে (ক্রস ইকুইটেরিয়াল ফ্লো) মৌসুমি বায়ুর অক্ষকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া।

গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই ‘ক্রস ইকুইটেরিয়াল ফ্লো’র প্রভাবে মৌসুমি বায়ুর অক্ষ হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত ও সক্রিয়। আবার এর বর্ধিত একটি অংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ও সক্রিয়।

আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণারত আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, মূলত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এই অক্ষ ১১ আগস্ট থেকে হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। ওই অক্ষভুক্ত অঞ্চলেই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা নদীর উৎস এবং অববাহিকা শুরু হয়েছে। ফলে ওই বৃষ্টির পানি গড়িয়ে এসে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশে বন্যার কারণ হয়েছে।

সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ফলে ওই তিন বছর বাংলাদেশে বড় বন্যা দেখা দেয়। অবশ্য ওই তিন বছরই হিমালয়ের পাদদেশে মৌসুমি অক্ষের অবস্থান ছিল প্রায় দুই সপ্তাহ। ফলে অনেক দিন ধরে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে ১০-১১ আগস্ট থেকে। আরও বৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থা এখনো আছে। এবারও যদি হিমালয়ের পাদদেশে মৌসুমি অক্ষের অবস্থান আগের ওই বছরগুলোর মতো দীর্ঘায়িত হয় তাহলে বড় বন্যা হতে পারে। কারণ সেখানকার বৃষ্টির পানি সাগরে গড়ানোর পথ তো নেপাল-ভারত-বাংলাদেশের ওপর দিয়েই।

মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবনকেন্দ্রের (স্পারসো) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুমণ্ডলে বাতাসের গতি, চাপ ও প্রবাহের দিক প্রভৃতিতে কিছুটা তারতম্য দেখতে পাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল অঞ্চলে পুবালি ও পশ্চিমা জেট বায়ু দুটিই প্রবল। পুবালি জেট বায়ুর অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। উজানে হিমালয়ের পাদদেশের মতো উত্তর বঙ্গোপসাগরেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।

স্পারসোর এই কর্মকর্তা বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে উজানে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে গঙ্গা অববাহিকায়। আর ব্রহ্মপুত্রের পানির স্তর ইতিমধ্যে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বড় বন্যার আশঙ্কা করাই যায়।

বিশিষ্ট পানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, এবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যে বন্যা হবে তা সবার জানা ছিল। পানিসম্পদমন্ত্রী সে কথা বলেছিলেন। তারপরও চলমান বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় এলোমেলো অবস্থা খুব দুঃখজনক। তিনি বলেন, এই বন্যা আরও সাত দিন, দশ দিন থাকবে। ঢাকা বন্যাকবলিত হলে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের অবস্থা খারাপ হবে।

বন্যা রাজধানীর আশপাশে চলে এসেছে

বন্যার পানি এবার দেশের মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে চলে এসেছে। রাজধানীর কাছের জেলা টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী ও মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর পাশে শীতলক্ষ্যার পানি বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন পানি ১২ সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী নদ বালুর পানি বিপৎসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার নিচে আছে, আর বাড়ছে ৯ সেন্টিমিটার করে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের প্রধান দুই অববাহিকা যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মার নদ-নদীর পানি প্রতিদিনই বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদ-নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করলেও তা এখনো বিপৎসীমার ওপরে আছে।

বন্যা পূর্বাভাসকেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্টের মধ্যে ৬০টির পানি বাড়ছে ও ২৬টির কমছে। আর ২৯টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে বৃষ্টি কিছু কমে আসবে। আগামীকাল শুক্রবারের মধ্যে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, বিহার, সিকিম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত আছে। ২০ আগস্ট পর্যন্ত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এই রাজ্যগুলোতে ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে বলে তাদের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।