বন্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র কমছে

রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে বন্য প্রাণীর বিচরণক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে। বনের ভেতরে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতি, গাছ চুরি, গাড়ি চলাচল ও পর্যটকদের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় এই উদ্যানে বন্য প্রাণীর আবাস হুমকিতে পড়েছে। বন বিভাগ বলছে, জাতীয় এই উদ্যান রক্ষা করার মতো জনবল তাদের নেই। অথচ এই উদ্যানে সম্বর হরিণ, সবুজ উচ্চিংড়া প্রজাপতিসহ বিরল প্রজাতির কয়েকটি প্রাণীর বসবাস, যা দেশের অন্য কোনো বনে নেই।

কাপ্তাইয়ের ১৩ হাজার ৬৬১ একর বনাঞ্চলকে ১৯৯৯ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। কাপ্তাই উপজেলা পরিষদ ভবন থেকে দুই কিলোমিটার দূরে এই উদ্যানের অবস্থান। এখানে অর্জুন, বহেরা, বৈলাম, চিকরাশী, চম্পাফুল, শিলকরই, ঢাকি জাম, গর্জন, উরি আম, চাপালিশ, বাটনা, জারুল গোদাসহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ, লতা-গুল্ম ও বন্য প্রাণী রয়েছে।

 বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে সবুজ উচ্চিংড়া ও সিঁদুরে-কালো উচ্চিংড়া প্রজাপতি রয়েছে, যা দেশের অন্য কোনো বনে নেই। গেছোবাঘ, সম্বর হরিণসহ বিরল প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে এখানে। এই উদ্যানে যেভাবে জনবসতি ও স্থাপনা বাড়ছে, তাতে বিরল প্রজাতির প্রাণী ভবিষ্যতে আর টিকে থাকতে পারবে না। এই উদ্যান রক্ষা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগ দরকার। পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদেরও এই উদ্যান রক্ষার বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে ৬২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি, ৭৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৩৫৮ প্রজাতির পাখি ও ২২১ প্রজাতির প্রজাপতি পেয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মো. মনিরুল হাসান খানের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই গবেষণায় কাপ্তাই উদ্যানে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১৬ সালে পরিচালিত ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, কাপ্তাইয়ের উদ্যানে গেছোবাঘ, হনুমান, কাঠময়ূর, ধূসর কাঠঠোকরা, বনছাগল, খুদে মাছরাঙা, উল্লুকসহ ১৭টি বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী বাস করে। এ ছাড়া দুটি বিরল প্রজাতির প্রজাপতিও খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা।

 গবেষক মো. মনিরুল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া এবং উদ্যানের ভেতরে বসতি গড়ে ওঠায় বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় বেশ কয়েকবার উদ্যানে আগুন লাগার ঘটনার প্রমাণ পেয়েছি। পর্যটক ও এলাকাবাসীর ফেলে দেওয়া সিগারেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এই উদ্যানের ভেতরে অবৈধ বসতিসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠায় বন্য প্রাণীর জীবন হুমকিতে পড়েছে। যেসব বন্য প্রাণী কোলাহলমুক্ত থাকতে পছন্দ করে, তাদের বেশি সমস্যা হচ্ছে।’

কাপ্তাই সদর থেকে উপজেলার নতুন বাজার পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের তিন কিলোমিটার অংশ গেছে উদ্যানের ভেতরে দিয়ে। এই সড়কে গণপরিবহন চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ির ধোঁয়া, শব্দ ও কম্পনের কারণে বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনে সমস্যা হচ্ছে।

সম্প্রতি জাতীয় উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, নতুন বাজার এলাকার পাশে উদ্যানের ভেতরে পাঁচ কিলোমিটার এলাকার দেড় শতাধিক পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে। এর বাইরে উদ্যানের ভেতরে বন বিভাগের বনফুল বিশ্রামাগার এলাকা, ব্যাঙছড়ি, শিলছড়ি, শুকনাছড়ির মুরগি টিলা এলাকায় আরও কয়েক শ ঘরবাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া উদ্যানের ভেতরে বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের দপ্তরও রয়েছে।

কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান বন বিভাগের দুটি রেঞ্জের আওতাধীন। কাপ্তাই রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শরিফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় উদ্যানের ভেতরে পাঁচ শতাধিক পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে। প্রতিবছর অবৈধ বসতি বাড়ছে। বন বিভাগের লোকজন থাকায় অবৈধ বসতি সরানো যাচ্ছে না, আবার নতুন বসতিও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের ১৩ জুন কাপ্তাইয়ে পাহাড়ধসের পর ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু পরিবার উদ্যানের ভেতরে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তাদের বসতি করতে দেননি তাঁরা। গাছ চুরি ও বন্য প্রাণী শিকারের ঘটনা বাড়ছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।

 বন বিভাগ সূত্র জানায়, জাতীয় উদ্যানে দুই রেঞ্জ মিলে ৬৪ জন বন প্রহরী থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ২২ জন। এ ছাড়া রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তার ৬টি পদ শূন্য। গাছ চুরির অভিযোগে গত এক বছরে কাপ্তাই থানায় মামলা হয়েছে ৭৮টি।

কর্ণফুলী রেঞ্জের কাপ্তাইমুখ বিট কর্মকর্তা জয়ন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘আমার বিটে কমপক্ষে ২০ জন বন প্রহরীর প্রয়োজন। কিন্তু আছেন শুধু ৩ জন। বিটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিন-রাত পাহারা দিতে হচ্ছে। তারপরও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের।’

এত কম বন প্রহরী দিয়ে জাতীয় উদ্যান রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন কর্ণফুলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবদুল মাল শেখ।

এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় উপ-বন সংরক্ষক মো. তৌফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাইয়ের জাতীয় উদ্যান রক্ষা করতে হলে সেখানকার দুটি রেঞ্জে অনুমোদিত পদের (৬৪টি) চেয়ে দ্বিগুণ বন প্রহরী প্রয়োজন। অথচ অনুমোদিত পদের মাত্র ২২ জন বন প্রহরী কাজ করছেন। এ অবস্থায় জাতীয় উদ্যানে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করাও কঠিন।