বন্য প্রাণীর শত্রু-মিত্র বনাম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দায়

ফাইল ছবি

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন গত বুধবার রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে বন্য প্রাণী রক্ষাবিষয়ক এক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি দেশের বন্য প্রাণী সুরক্ষাবিষয়ক একটি নতুন তথ্য দেন। তিনি জানান, দেশে পাহাড়ের ভেতর খাসিয়াসহ বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাসের কারণে ‘বন্য পশুরা নিরাপদ নয়’। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হলো। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বন্য প্রাণীর এই বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের যে বয়ান মন্ত্রী দিলেন, বাস্তবতায় তার উল্টো তথ্য-উপাত্ত বেশি পাওয়া গেল।

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার সাসটেইনিবিলিটি’ থেকে ২০১৮ সালে বিশ্বের বনভূমি ও বন্য প্রাণী রক্ষায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভূমিকা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন করা হয়। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউএনইপির জন্য করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বনভূমি ও বন্য প্রাণী রক্ষা করে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা। পশ্চিমা দেশগুলোতে যাদের আদিবাসী বা ইন্ডিজেনাস কমিউনিটি বলা হয়। এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা পরিবেশ ও বন্য প্রাণী রক্ষাকে নিজেদের সংস্কৃতি, ধর্ম আর আচারের অংশ হিসেবে পালন করেন।

আমাজান থেকে সুন্দরবন—পৃথিবীর যে প্রান্তের বনভূমিতেই যাওয়া যাবে, সেখানে বন্য প্রাণী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধপূর্ণ নয়, ছন্দময় সম্পর্ক পাওয়া যাবে। জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য রক্ষাবিষয়ক সনদ সিবিডিতে বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভূমিকাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশও ওই সনদের অন্যতম স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। অর্থাৎ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে বন্য প্রাণী রক্ষার অন্যতম সহকারী শক্তি হিসেবে তাতে বলা হয়েছে।

শুধু বৈশ্বিক আইনে নয়, ২০১২ সালের দেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বন্য প্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব বিশ্বাস ব্যবস্থাকে সম্মান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বন্য প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত প্রাণী এবং প্রাণীর শরীরের কোনো অংশ সংরক্ষণ বা পরিবহন করা যাবে না। তবে তা যদি কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রথাগত ঐতিহ্য বা জীবন ধারণের অংশ হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে না।

দেশের বন্য প্রাণী আইনে এ ধারা যুক্ত করার ক্ষেত্রে অবশ্য একটি প্রেক্ষাপট আছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮৭টি দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বন্য প্রাণীদের সম্পর্ক নিয়ে করা ইউএনইপির ওই গবেষণায় দেখা গেছে, এসব দেশের আদিবাসীরা নিজস্ব সংস্কৃতিতে বন্য প্রাণীকে তাদের অস্তিত্বের অংশ মনে করে। তাদের বেশির ভাগই টোটেম বা এ–জাতীয় প্রতীক হিসেবে একটি বন্য প্রাণীকে সম্মান করে, যা হত্যা করাকে তারা ওই জাতিগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে গণ্য করে থাকে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তফসিলভুক্ত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রাণী হত্যাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের নিশ্চয়ই মনে থাকবে, ১৯৯৮ সালে ভারতের যোধপুরে একটি চলচিত্রের শুটিংয়ে গিয়ে বলিউড সুপারস্টার সালমান খান একটি কৃষ্ণসার হরিণ গুলি করে হত্যা করেছিলেন। ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই মামলায় সালমান খানকে এখনো কোর্টে হাজিরা দিতে হচ্ছে। এই গত ১৭ জানুয়ারিও ভারতের উচ্চ আদালতে তাঁকে এ জন্য হাজির হতে হয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, দেশে ও বৈশ্বিকভাবে বন্য প্রাণী রক্ষায় যে আদিবাসীদের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তাদের হঠাৎ কেন মন্ত্রী বন্য প্রাণীর জন্য ‘ভিলেন’ চরিত্রে হাজির করলেন। মন্ত্রী যদি ভালোমতো খোঁজ নেন, তাহলে দেশের বন্য প্রাণীর আশ্রয়কেন্দ্র বনভূমি কারা ধ্বংস করছেন, কারা একের পর এক সংরক্ষিত বন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দিচ্ছেন, তা সঠিকভাবে জানতে পারবেন।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে বন বিভাগ থেকে দেশের বন দখলের হিসাব তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, দেশের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর সংরক্ষিত বনভূমির দখলদার ৮৮ হাজার ২১৫ জন। তাঁদের মধ্যে ৭২ হাজার ৩৫১ জনের দখলে দেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ দশমিক ৭৮ একর বনভূমি।

মন্ত্রী আপনি নিশ্চয়ই ওই দখলদারদের তালিকায় থাকা নামগুলো দেখেছেন। সেখানে কতজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাম আছে, আর কতজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম আছে, তা নিশ্চয়ই জানবেন। গত ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বন দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় আপনি দখলদারদের উচ্ছেদ করারও ঘোষণা দিয়েছেন। সেটা এখন পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সে বিষয়ে আপনি নিশ্চয়ই সংসদে বা অন্য কোনোভাবে দেশবাসীকে জানাবেন। কারণ, দেশের বন আইনে বনভূমি রক্ষার দায়িত্ব আপনার মন্ত্রণালয়ের।

হঠাৎ বন্য প্রাণীর নিরাপত্তাহীনতার জন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের বসতিকে দায়ী করার আগের দুই বছরে দেশে বন্য প্রাণী হত্যার তথ্য নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে। কারণ, সংসদে সরকারি দলের একজন সাংসদের দেওয়া প্রশ্নের জবাবে গত সেপ্টেম্বরে আপনি জানিয়েছিলেন, গত ২৪ বছরে মোট ২৪টি বাঘকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর ১০টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে একটি করে বাঘ হত্যার শিকার হচ্ছে। এই তো চলতি মাসে আরেকটি বাঘের মৃতদেহ সুন্দরবনের পাশে পাওয়া গেল। এসব ঘটনায় কারা জড়িত, তা আপনার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে থাকা বন বিভাগ নিশ্চয়ই জানে।

২০১৬ সালে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল থেকে বাংলাদেশের বাঘ হত্যা নিয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় বাঘ হত্যা ও চোরাচালানে একটি প্রভাবশালী মহল যুক্ত। ওই মহলের ভরকেন্দ্রে রয়েছেন সুন্দরবনসংলগ্ন সাতক্ষীরা জেলার সরকার দলীয় এক সাংসদ ও তিন ইউপি সদস্য। এই জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাঁরা বেশ বহাল তবিয়তে আছেন।

সম্প্রতি দেশে হাতি হত্যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সরকার হাতি রক্ষায় পরিকল্পনা করেছে। ভারত-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী হাতিদের জন্য সীমান্তে করিডর করার জন্য কাজ করছে। কিন্তু এসব ভালো উদ্যোগের বিপরীতে যখন আমরা দেখি, গত ১২ দিনে সারা দেশে ৫টি হাতি হত্যার শিকার হয়েছে। তখন প্রশ্ন উঠে, দেশের প্রায় ২৫০টি হাতির মধ্যে যদি এই অল্প সময়ে এতগুলো হাতি হত্যার শিকার হয়, তাহলে বাকি হাতিগুলো শেষ হতে কত সময় লাগবে, বলা যায়, তার দিনক্ষণ গোনার সময় হয়ে গেছে।

গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত দেশে ২২টি ডলফিন ও ৩টি তিমি মারা গেছে। এসব হত্যার দায় কি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর চাপাবেন? সেই সুযোগ সম্ভবত আপনি পাবেন না। কারণ, তেমন কোনো প্রমাণ সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই। বরং আপনার নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় একটি সাফারি পার্ক করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। লাঠিটিলা নামের একটি সংরক্ষিত বনে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ওই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরুর প্রক্রিয়া চলছে। দেশের বন্য প্রাণীর জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওই বনভূমিতে বিলুপ্তপ্রায় চিতাসহ অনেক প্রাণীদের শেষ আশ্রয়স্থল। ওই বনভূমির পাশে একটি জাতিগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষের বসবাস। তারা এ পর্যন্ত কোনো বন্য প্রাণী হত্যা করেছে, এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি।

বরং ওই সাফারি পার্ক নির্মিত হলে সেখানে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ দর্শনার্থী যাবে। এর আগে গাজীপুরের ভাওয়াল বন ও চুনতী বনভূমিতেও সাফারি পার্ক হয়েছে। এসব সাফারি পার্কে যাতায়াতকারী দর্শনার্থীদের কারণে বন্য প্রাণীদের কী অবস্থা হয়, তার অনেক প্রমাণ আছে। কক্সবাজারের মহেশখালী-সোনাদিয়া-মেরিন রোডের পাশের বনভূমি একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে দখলও চলছে সমানতালে। এসব কর্মকাণ্ড কী পরিমাণে বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল নষ্ট করছে, সেই হিসাব তো মন্ত্রণালয় আর বন বিভাগের করার কথা। তারা কি তা করেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের কাছে নাগরিকেরা চাইতেই পারে।

দেশের বনভূমির এতগুলো শত্রু বাদ দিয়ে মন্ত্রী কেন বিশ্বজুড়ে বন্য প্রাণীর মিত্র হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করলেন, তা পরিষ্কার বোঝা গেল না। নাকি তিনি বুঝেশুনে মূল শত্রু বাদ দিয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা থেকে কোণঠাসা হওয়া ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে বন্য প্রাণীর শত্রু বানালেন, তা হয়তো একদিন ইতিহাস বিবেচনা করবে। দেশের বন্য প্রাণী রক্ষা করতে হলে দেশের আইনের সঠিক বাস্তবায়ন আর প্রকৃত শত্রুদের দিকে তির ছুড়তে হবে, যা করার প্রধান দায়িত্ব মন্ত্রীর।