বন্যায় ক্ষতি কমেছে, তবে দুর্যোগ বাড়ায় খাদ্যমজুত বৃদ্ধির তাগিদ

দেশে দুর্যোগের ঘনঘটা বেড়েছে
ফাইল ছবি

বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতির তথ্যের মধ্যেও একটা ইতিবাচক খবর রয়েছে প্রতিবেদনটিতে। দেশে বন্যার কারণে সম্পদের গড় ক্ষতি এখন কমে এসেছে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, চলতি বছর অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় ও কয়েক দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। বছরের বাকি সময়ও দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে বলে আশঙ্কা কৃষি আবহাওয়াবিদদের। তাই তাঁরা বলছেন, ঘন ঘন দুর্যোগের কারণে দেশের কৃষি খাতকে প্রস্তুত রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় খাদ্যের মজুত বাড়াতে হবে।

কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের কারণে আগে থেকেই বিপদে। কয়েক বছর ধরে এসব দুর্যোগ আরও বেড়েছে। ফলে আমাদের আগামী দিনের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের কাজ বেশি করে করতে হবে। সে ব্যাপারে আমরা কাজ শুরুও করে দিয়েছি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের বড় বিপদে আছি। সেটি এ বছর অনেক বেশি স্পষ্ট। ফলে আমাদের অবশ্যই কৃষিকে এসব দুর্যোগ মোকাবিলার উপযোগী করে তৈরি করতে হবে।’

দুর্যোগের ঘনঘটার এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে বাংলাদেশে। দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘সবাইকে নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যত্ন নিন, সুস্থ থাকুন। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ।’

লা নিনার প্রভাব

বৈশ্বিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি ও পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন এমন গবেষক ও সংস্থাগুলো বলছে, এই বছরের গেল মাসগুলোর মতো বাকি মাসগুলোও দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই দুর্যোগের কারণ বঙ্গোপসাগর ছাড়িয়ে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে গিয়ে খুঁজতে হবে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কেন্দ্রের দৃশ্য
ফাইল ছবি: এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে ‘লা নিনা’ নামের একটি বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাসাগরবিষয়ক সংস্থা এনসো প্রেডিকশন সেন্টারের প্রধান বিজ্ঞানী ড. রাশেদ চৌধুরীর সঙ্গে এ বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বিশ্বজুড়ে এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব নিয়ে ৩০ বছর ধরে গবেষণা করছেন। তাঁর মতে, এ বছর লা নিনার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সাগর উত্তপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে তার প্রভাব পড়েছে। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হওয়ায় সেখানে ঘন ঘন নিম্নচাপ ও ঝড় হানা দিচ্ছে। ফলে আগামী কয়েক মাস বৃষ্টি বেশি হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, লা নিনা সৃষ্টি হলে সাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়।

ফলে সেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঝড়, জলীয়বাষ্প ও নিম্নচাপ তৈরি হয়। চলতি বছরের শুরু থেকেই ওই লা নিনা অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। বাংলাদেশে গত জুলাই থেকে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত যে পাঁচ দফা বন্যা হয়েছে, তার কারণ হিসেবে জাতিসংঘের দুর্যোগবিষয়ক সংস্থা থেকে লা নিনাকে দায়ী করা হয়।
গত এপ্রিলে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দুই–তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা থেকে প্রকাশ করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন্যার কারণে সম্পদের গড় ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত কমে এসেছে

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জলবায়ু বিভাগের পর্যবেক্ষণেও দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে চার ডিগ্রি বেশি উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। যেখানে থাকার কথা ২৬–২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে আছে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের বাকি মাসগুলো বঙ্গোপসাগরের উত্তাপের কারণে বৃষ্টিবহুল হবে। দুর্যোগও বেশি হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, লা নিনার প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তপ্ত রয়েছে।

ফলে এবারের বর্ষা বিদায় নিতে এ মাসের পুরোটা লেগে যেতে পারে। শীত আসতেও দেরি হতে পারে। এর প্রভাব দেশের কৃষির ওপর পড়তে পারে। কাজেই সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

বন্যার মাথাপিছু ক্ষতি কমেছে

বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত ‘জলবায়ু সেবা পরিস্থিতি ২০২০’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা থেকে প্রকাশ করা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন্যার কারণে সম্পদের গড় ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত কমে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্দিষ্ট এলাকায় আগে বন্যায় মাথাপিছু ৬ হাজার ৬১৭ টাকার (৭৮ ডলার) ক্ষতি হয়েছিল। এখন উদ্দিষ্ট এলাকায় এই ক্ষতির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাথাপিছু ৪ হাজার ৮৩৫ টাকা (৫৭ ডলার)। অর্থাৎ, বন্যায় মাথাপিছু ক্ষতি কমেছে ২৭ শতাংশ।

এবারের বর্ষা বিদায় নিতে এ মাসের পুরোটা লেগে যেতে পারে। শীত আসতেও দেরি হতে পারে। এর প্রভাব দেশের কৃষির ওপর পড়তে পারে। কাজেই সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে

চলতি বছর শান্তিতে নোবেলজয়ী জাতিসংঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) করা জরিপে এই তথ্য পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়, বন্যার পূর্বাভাস ব্যবস্থার উন্নতির কারণে মানুষের সম্পদের এই ক্ষতি কমেছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস, ডব্লিউএফপি, রেড ক্রিসেন্ট প্রভৃতি সংস্থা যৌথভাবে এই পূর্বাভাস দেওয়ার কাজ করছে।

প্রতিবেদনটিতে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে সম্পদের ক্ষতি কমানোর কেস স্টাডি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।

মূলত দরিদ্র দেশগুলো কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে সম্পদের ক্ষতি কমাচ্ছে, তা প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে।