বালুখেকোদের হাতে সোমেশ্বরীর সর্বনাশ

বালুমহালের ইজারাদারেরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁরা আইন অমান্য করে নদী থেকে বালু তুলছেন।

সোমেশ্বরীর বুকে অসংখ্য অবৈধ ড্রেজার। খুবলে নেওয়া হচ্ছে বালু। অতি সম্প্রতি তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে অপরূপ সৌন্দর্যের সোমেশ্বরী নদী। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের রানীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদী পর্যটকদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়।

কিন্তু নদীটি পড়েছে অস্তিত্বসংকটে। নদীর সর্বনাশ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তের এক কিলোমিটার ভাটি বিজয়পুর ও ভবানীপুর থেকে। এখান থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার ভাটিতে অন্তত পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। এসব বালুমহালে নিয়ম ভঙ্গ করে তোলা হচ্ছে বালু। দুর্গাপুরের এক স্কুলশিক্ষকের কথায়, চোখের সামনে নদীটিকে খুন করা হচ্ছে। কিন্তু একে বাঁচানোর কোনো ভাবনা কারও মধ্যে নেই।

মূলত সোমেশ্বরী নদীর বালু ঘিরে দুর্গাপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি চক্র তৈরি হয়েছে। এই চক্রের সদস্যরাই প্রতিবছর বালুমহালের ইজারা পান এবং তাঁরাই নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বেপরোয়াভাবে বালু তুলছেন। তবে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের ভাষ্য, তারা নিয়ম মেনে বালু তুলতে ইজারাদের সব সময় তাগিদ দিয়ে থাকে।

সোমেশ্বরী নদীর বালুমহাল ইজারার শর্তাবলিতে বলা হয়েছিল, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুসারে পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করা যাবে না। বলা হয়েছিল, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য, জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বালু উত্তোলন করা যাবে না।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইজারাদারেরা এসব শর্তের কিছুই মানছেন না। তিনটি বালুমহালের পাঁচ কিলোমিটার নদীর অংশে দিনরাত হাজারখানেক নিষিদ্ধ ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বালুর সঙ্গে দেদার উঠছে পাথর ও কয়লা। বালুখেকোরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে সড়ক, সেতু ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধকে।

নিষিদ্ধ ড্রেজারে বালু উত্তোলন

সোমেশ্বরী নদীর তেরিবাজার ঘাট থেকে দেখা গেল নদীর বুকে বালুর ট্রাকের লম্বা সারি। কোনোটা বালু নিয়ে যাচ্ছে। কোনোটা আসছে। কোনোটা দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় ট্রাকচালক ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোমেশ্বরী নদী থেকে প্রতিদিন ছয়-সাত শ বড় ট্রাকে বালু বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি বড় ট্রাকে বালু ওঠে ৫২০ থেকে ৫৮০ ঘনফুট। এ ছাড়া প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মিনিট্রাক ও লরিতে বালু পরিবহন করা হয়। সব মিলে প্রতিদিন সোমেশ্বরী থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ঘনফুট বালু ওঠে।

ডাকুমারা ইসলামপুরের বাসিন্দা বাসন্তী রানী জানান, নদীতীরবর্তী জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করায় তাঁদের বাড়ির নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। এ রকম সমস্যায় পড়েছে অন্তত ১৫টি পরিবার।

যদি সোমেশ্বরীকে বাঁচাতে হয়, একে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে অন্তত পাঁচ বছর এখান থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

দুর্গাপুরের শ্মশানঘাট থেকে চেরানখোলা পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেল, নদীতে শত শত নিষিদ্ধ পাম্প ড্রেজার বসানো হয়েছে। এগুলোর নাম ছয় সিলিন্ডার বা চার সিলিন্ডারের বাংলা ড্রেজার। আজিজুল নামে এক ড্রেজারচালক বলেন, এগুলো দিয়ে নদীর ৫০-৮০ ফুট গভীর থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এসব ড্রেজারে বালু ও পাথর একসঙ্গে ওঠে। এবড়োখেবড়োভাবে বালু তোলায় নদীর বিভিন্ন স্থানে গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একজন প্রকৌশলী বলেন, নিয়ম হলো, বালুমহাল থেকে কতটা বালু কাটা হবে, তা সমীক্ষা করে নিতে হবে। বালু উত্তোলনে ‘কাটার সাকশন ড্রেজার’ ব্যবহার করতে হবে, যাতে নদীতে সমভাবে সুইং করে তলদেশ সুষম খনন করা যায়। কিন্তু সাধারণ যেসব ড্রেজার ব্যবহার করা হয়, এগুলো পাম্প ড্রেজার। এগুলো এক জায়গায় গর্ত করে বালু তোলে। ফলে চারপাশ থেকে ভেঙে পড়ে। এসব ড্রেজার ব্যবহার নদীর পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বালুমহাল আইনে এসব ড্রেজারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

হুমকির মুখে সড়ক, বাঁধ ও সেতু

নদীর ডান তীরের ডাকুমারা ইসলামপুরে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর তীরসংলগ্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, সোমেশ্বরী নদীর ডান দিকে ৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। তীর থেকে বালু উত্তোলন বাঁধের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁরা বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানাবেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব বালু পরিবহন করা হয় বিরিশিরিতে নির্মিত সোমেশ্বরী সেতু দিয়ে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এই সেতুর পূর্ব পাশে ৫০০ মিটারের মধ্যে রাতে বালু তোলা হয়। এতে সেতুটি হুমকির মুখে পড়েছে।

জেলা সওজ সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামগঞ্জ-জারিয়া-বিরিশিরি-দুর্গাপুর মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত ওজন ও ভেজা বালু পরিবহনের কারণে এই সড়কও দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক ও জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কাজী মো. আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত করছি, কারণ দর্শানোর নোটিশ দিচ্ছি। যারা বালু উত্তোলন করছে, তারা সমাজের বাইরের কেউ না। আমরা তাদেরও সহযোগিতা চাই।’

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে স্পষ্ট বলা আছে, কোনো অবস্থাতেই বালু ব্যতীত মাটি বা অন্য কিছু উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু সোমেশ্বরী নদী থেকে বালুর সঙ্গে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, এসব পাথর বালুর ট্রাকের সঙ্গে রাতের আঁধারে সরানো হয়

বালুমহালের নিয়ন্ত্রক কারা

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালুমহালের নিয়ন্ত্রক হিসেবে যাঁদের নাম আসে তাঁরা হলেন দুর্গাপুর পৌর মেয়র আলা উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিন আল আজাদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস তালুকদার, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, দুর্গাপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুছ সালাম, উপজেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, জেলা পরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম, দুর্গাপুর সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহীনুর আলম ও বিরিশিরি ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম।

জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীতে পাঁচটি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে ১, ২ ও ৩ নম্বর বালুমহাল বড়। ১৪২৮ বঙ্গাব্দে এগুলো ইজারা হয় যথাক্রমে ৩৩ কোটি, ১৫ কোটি ও প্রায় দেড় কোটি টাকায়। তবে ১ নম্বর বালুমহালের ইজারাদার টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ওই ইজারা বাতিল করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মনির হোসেন জানান, চতুর্থ দফা নিলামের মাধ্যমে এই বালুমহাল ৩ জানুয়ারি প্রায় ১৪ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া হয়।

২ নম্বর বালুমহাল চালাচ্ছেন দুর্গাপুর পৌরসভার মেয়র আলা উদ্দিন নিজেই। তবে ইজারা হয়েছে তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ধনেশ পত্রনবিশের নামে। ৩ নম্বর বালুমহালের ইজারা পেয়েছেন উপজেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাইফুল ইসলাম। আর ব্যবসায়ী অঞ্জন সরকার পেয়েছেন নতুন করে ইজারা হওয়া ১ নম্বর বালুমহাল।

বালু ও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, তিনটি বালুমহালে দিনে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার বালু বিক্রি হয়।

দুর্গাপুর পৌরসভার মেয়র আলা উদ্দিনের দাবি, তাঁরা সরকারি নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি হক ব্যবসা করছি। কোনো চাঁদাবাজি করছি না।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দিন আল আজাদ ২ ও ৩ নম্বর বালুমহালে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের কমবেশি সবাই আছেন।

তবে উপজেলা চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌস তালুকদার সরাসরি বালুমহালের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেছেন।

সোমেশ্বরী নদীর বালুমহালের ইজারা বাতিল চেয়ে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলা করেছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সোমেশ্বরী নদী এখন একটি বালুমহাল হয়ে গেছে। যদি সোমেশ্বরীকে বাঁচাতে হয়, একে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে অন্তত পাঁচ বছর এখান থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করতে হবে।