ঈদের ছুটিতে সদলবল গিয়েছিলাম হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলায়। তবে বাহুবল মানে সেখানকার উপজেলা শহর বা শহরতলিও নয়। আমরা গিয়েছিলাম উপজেলার এক প্রান্তে। ফয়জাবাদ চা-বাগানলাগোয়া স্থানটি ভৌগোলিকভাবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রান্ত ঘেঁষেই অবস্থিত। থাকার বন্দোবস্ত টিলার ওপরে, মনোমুগ্ধকর একটি রিসোর্টে। চারপাশে লেবু, আনারস আর চা-বাগান। এমন জনবিচ্ছিন্ন স্থানে খুব কমই থেকেছি।
সারা দিনে আশপাশে চোখ রেখে হাতেগোনা কয়েকজনের দেখা পাওয়া গেল! ছিল না কোনো ধোঁয়া, দূষণ, শব্দ আর কোলাহল। হাতের নাগালেই ছিল চা-গাছ, বীথিবদ্ধ আনারস বাগান, লেবু বাগান আর ফলভর্তি অসংখ্য কাঁঠালগাছ।
একসঙ্গে এত কিছু! দ্বিতীয় দিন সিদ্ধান্ত হলো, অনতিদূরে বাহুবলের পুটিজুরি বনটি দেখতে যাব। ধারেকাছে দেখার মতো একটিই স্থান! দলের অন্য সদস্যরা তাতে সায় দিলেও খুব বেশি খুশি হলেন বলে মনে হলো না। কারণ, বন আমার কাছে তীর্থভূমি হলেও অন্যদের কাছে তা না-ও হতে পারে।
একটি জিপ ভাড়া করা হলো। দুপুরে খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ধীরে ধীরে চলছে গাড়ি। দুপাশে লেবু, আনারস আর বিচিত্র ফসলের জমিগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এল। তারপর শুরু হলো বন। বনের প্রধান বৃক্ষ আকাশমণি! বন বিভাগ অতি দক্ষতার সঙ্গে এখানকার শতসহস্র বছরের সব বৃক্ষ সাফসুতরো করে বিদেশি গাছের জঞ্জাল বেশ সাফল্যের সঙ্গেই বুনে রেখেছে।
‘ওয়াই’ জংশনের মতো একটি স্থানে গাড়ি থামালেন চালক। তিনি জানতে চাইলেন, আমরা কোন দিকে যাব, ডানে না বাঁয়ে? কিছু না বুঝেই ডানে যেতে বললাম। দুপাশে গাছপালার ঘন আচ্ছাদন। দিনের আলোতেই অন্ধকার জমে আছে। ঝিঁঝি পোকাগুলো তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে রীতিমতো ভয় লাগিয়ে দিল। এদিকে গাড়িচালক শুরু করলেন বানরের গল্প। তিনি বোঝাতে চাইলেন, এখানকার বানরগুলো মাঝেমধ্যে মানুষকে আক্রমণ করে।
আবার অভয় দিয়ে বলেন, ওদের সমঝে চললে আক্রমণ করে না। খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। গল্পের ফাঁকেই একটি অচেনা ফুল চোখে পড়ল। নেমে দেখব কি না, এ সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই গাড়ি খানিকটা এগিয়ে গেল। কিন্তু প্রকৃতি যেন আমার আক্ষেপ অনুভব করতে পারল, অনতি দূরেই আরেক গুচ্ছ ফুল পাওয়া গেল। গাড়ি থামিয়ে ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখে ছবি তুলে নিলাম।
সঠিক শনাক্তের জন্য সেই ছবি পাঠিয়ে দিলাম বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিনের কাছে। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে গাছটি ‘হেলগাছ’ নামে পরিচিত। পরের দিন গাছটি আবার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও দেখেছি।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-এর তথ্যমতে, এ গাছ সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় জন্মে। বর্তমানে গাছটি সংকটাপন্ন। হেলগাছ (Chassalia curviflora var. ophioxyloides) ছোট আকৃতির গুল্ম। সাধারণত দেড় মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা উপপত্রযুক্ত এবং পত্রবৃন্ত আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা।
পাতা ১০ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা, মসৃণ, শীর্ষ দীর্ঘাগ্র এবং গোড়া সরু। ফুলের বিন্যাস শাখান্বিত, ঘন ও বৃন্তহীন। বৃতিখণ্ডক খাটো, ত্রিকোণ আকৃতির ও গোড়া পাঁচ খণ্ডক। পাপড়িনল এক থেকে আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, সরু ও বাঁকানো। পুংকেশর পাঁচটি, দললগ্ন, পাপড়ির সঙ্গে একান্তর, পরাগধানী রেখাকার ও পৃষ্ঠলগ্ন। ফল আড়াআড়িভাবে এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার গোলাকার ও জোড়াবদ্ধ। ফুল ও ফলের মৌসুম এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিস্তৃত।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক