আজ থেকে ২০ বছর আগে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরে অজানা একটি উদ্ভিদের বীজ পাই। বীজটি নদীর জলে ভেসে এসে তীরে জমে গিয়েছিল। এটি ছিল খুবই হালকা। বীজটি সংগ্রহ করে বাসায় রেখে দিই। প্রায় এক বছর পরে একদিন দেখি, সে অঙ্কুরিত হয়েছে। তারপর তাকে টবে লাগাই এবং দ্রুতই সে বেড়ে ওঠে। পাতা বড় হওয়ার পরই বুঝতে পারি, সে লিলি ফুলের প্রজাতি। ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং একদিন তার কাণ্ডের আগায় ফুল আসে। এক অজানা বীজ থেকে এমন বুনো ফুলের সান্নিধ্য আমার কাছে ছিল পরম পাওয়া। যদি তার সঙ্গে না দেখা হতো, তাহলে সে হয়তো অচেনাই থেকে যেত!
বুনো লিলি বহুবর্ষজীবী বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এটির ইংরেজি নাম রিভার ক্রিনাম লিলি। বৈজ্ঞানিক নাম Crinum viviparum| cwievi Amaryllidaceae। বৈজ্ঞানিক নামের শেষ অংশ ল্যাটিন শব্দ ভিভিপ্যারাম বলতে গাছে ফল থাকা অবস্থায় বীজ অঙ্কুরিত হওয়াকে বোঝায়। সাধারণত নোনাপানির বন বা জোয়ার-ভাটার বনের উদ্ভিদে এ ধরনের অঙ্কুরোদ্গম কৌশল থাকে। গাছে ফল থাকা অবস্থায় বীজ অঙ্কুরিত কচি মূল, মুকুলসহ বীজটি ঝরে পড়ে নরম কাদায় গেঁথে যায়। যে কারণে জোয়ারে খুব সহজেই অন্যত্র ভেসে যায় না। এই অভিযোজন পদ্ধতিকে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম বলা হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও বাংলাদেশে এটির কয়েকটি স্থানীয় নাম রয়েছে; যেমন পানি নহরু, জল কুঁইরি, বুনো লিলি, জলার লিলি ইত্যাদি। এটা মূলত জলজ পরিবেশে, মজা ও আর্দ্র জায়গায় জন্মে। টবে লাগালে প্রতিদিন পানি দিতে হয়। নদীর বা খালের অগভীর কিনার তার প্রকৃত আবাস।
নানা সময়ে এ বুনো লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের নদীর বাঁকে বাঁকে ও সুন্দরবনে। বরিশালের কীর্তনখোলা, ভোলার তেঁতুলিয়া, পটুয়াখালীর লাউকাঠি, পিরোজপুরের কচা, বরগুনার পায়রা, বাগেরহাটের মোংলা, খুলনার রূপসা ও ভৈরব নদীর কিনারে দেখা হয়েছে বুনো লিলির সঙ্গে। সুন্দরবনের অগভীর খালের পাশেও ফুলসহ অর্ধডোবা উদ্ভিদ বহুবার দেখেছি।
নোনা ও স্বাদু—দুই রকমের জলের মিশ্রণ পরিবেশে এ লিলি অভিযোজিত হয়েছে। সুন্দরবনে পুরো জোয়ারের সময় মূল কাণ্ড ডুবে যায়, কিন্তু ভাটা শুরু হলে লম্বা মঞ্জরিদণ্ড নিয়ে সাদা রঙের ফুলগুলো জেগে ওঠে। ছয়টি পাপড়িসমেত পুষ্পমঞ্জরির ছড়ানো এবং দেখতে নান্দনিক। ফুল ফোটে রাতে। তীব্র রোদে পাপড়িরা কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। ছায়াময় স্থানে হলে ফুল সতেজ থাকে।
সুন্দরবনের অনেক প্রজাতির ছোট মাছ, মাছের পোনা হারগোজাসহ এই বুনো লিলির ঝোপে আশ্রয় নেয়। ফুল সুগন্ধি, যে কারণে বুনো পোকামাকড় ফুলে বিচরণ করে। উদ্ভিদটির লোকজ ভেষজ গুণাগুণ নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে নিঃসন্দেহে সে শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ। শরতের চাঁদনী রাতে সুন্দরবনের নদীর তীরে তার শুভ্র ফুলের রূপটা অসাধারণ।
বুনো লিলির কাণ্ড প্রায় এক মিটার লম্বা হয়। ভূনিম্নস্থ বাল্ব ও বীজের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। বাল্বের প্রস্থ ৫-৮ সেন্টিমিটার। কাণ্ডে পাতা থাকে ৬-৮টি এবং প্রায় ৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। ফুলের পাপড়ি ৬-৮ সেন্টিমিটার লম্বা। প্রতিটি দলের সঙ্গে ছয়টি খয়েরি রঙের পুংকেশর থাকে। ফুল ফোটে শরৎকালে। বুনো লিলি বাংলাদেশসহ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের স্থানীয় উদ্ভিদ।