ব্রহ্মপুত্র খনন: কৃষিজমি-বসতভিটা নিয়ে শঙ্কা

বর্তমানে গ্রামের পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে খনন না করে বসতভিটা ও ফসলি জমির ভেতর দিয়ে খননের নকশা করা হয়েছে।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মরিচারচরের বাসিন্দাদের দিন কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। যে চরে দীর্ঘদিন ধরে তারা বসবাস করছে, চাষাবাদ করছেন, সে জমি এখন হাতছাড়া হতে চলেছে। কারণ, ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের চূড়ান্ত নকশায় প্রবহমান অংশ বাদ রেখে তাদের বসতভিটা ও কৃষিজমি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, নকশা অনুযায়ী ৪৭ একর ৯ শতাংশ জমি খনন প্রকল্পের আওতায় পড়েছে। বর্তমানে তাঁদের এলাকায় প্রবাহিত নদটি ধনুক আকৃতির। সেখানে নদটি খনন করতে ২৫০ মিটার বেশি খনন করতে হতো। সেটা না করে কোনাকুনি দেড় কিলোমিটার খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছ। এতে করে মরিচারচরের উর্বর আবাদি ভূমি নষ্ট হবে। গ্রামটি দ্বীপে পরিণত হবে। খননের জন্য দেওয়া হয়নি কোনো ক্ষতিপূরণও।

গত মঙ্গলবারে মরিচারচরে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এ উদ্বেগের কথা জানা যায়। সাইফুল মিয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র বর্তমানে গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে খনন না করে বসতভিটা ও ফসলি জমির ভেতর দিয়ে খনন করার কারণটা তাঁরা এখনো জানেন না। এতে তাঁরা অনেকেই ভূমিহীন হয়ে পড়বেন। বর্তমানে এই চরে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বসবাস।

হযরত আলী বলেন, সরকারি হুকুমে দখলের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কিন্তু সেটাও তাঁরা পাননি। তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ফসলি জমি এবং বসতবাড়ির পাশে লাল নিশানা টাঙিয়ে নদ খননের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। ড্রেজিং কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, মরিচারচর ভৌগোলিকভাবে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় হলেও এই এলাকা ত্রিশাল উপজেলার ফাতেমানগর বাজারের পাশে। বাজারে একটি রেলস্টেশনও রয়েছে। পায়ে হাঁটা দূরত্বে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ফাতেমানগরে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। এখান থেকেই গ্রামের মানুষজন সড়ক ও রেলপথে ময়মনসিংহ সদর ও ঢাকায় যাওয়া আসা করে। নকশা অনুযায়ী নদে খননকাজ হলে হাঁটা পথ পার হতে হবে নৌকায়। গ্রামের মানুষজন তখন দ্বীপের বাসিন্দাতে পরিণত হবে।

এ ছাড়া যে স্থান দিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি রয়েছে,সেখান দিয়ে নদ খননের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে করে মরিচারচরে বিদ্যুৎ সরবরাহও বিঘ্নিত হবে। খননের পর চর এলাকাতে ভাঙনের আশঙ্কা রয়েছে। তারা নানা হুমকিতে আছে। তারপরও প্রশাসন তাদের দিকে নজর দিচ্ছে না।

ভুক্তভোগীরা বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে কোনো সুরাহা হয়নি। গত রোববার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন ও স্মারকলিপি দিয়েছেন তাঁরা। এর আগে আগস্ট মাসে জেলা প্রশাসকের কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। উল্টা গ্রামবাসীকে চাষাবাদ করতে নিষেধ করেছে ড্রেজিং কর্তৃপক্ষ। অনেক কৃষক চলতি মৌসুমে ফসল আবাদ করতে পারেননি।

এ বিষয়ে ‘জনউদ্যোগ’ ময়মনসিংহ শাখার আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, নদ খনন ইতিবাচক হলেও গ্রামবাসী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে তাঁদের ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সরকারি হুকুমে দখলের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। কিন্তু সেটা পাইনি। কোনো আলোচনাও করেনি।
হযরত আলী, স্থানীয় বাসিন্দা

পরিবেশ রক্ষা উন্নয়ন আন্দোলন (পরউআ) সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আহমেদ বলেন, কৃষিজমি ও বসতভিটাতে খননকাজ শুরু করা হলে ব্যাপক অর্থের অপচয় হবে এবং গ্রামবাসীরা নিঃস্ব হবে। তাই বর্তমানে স্রোতোধারা অনুযায়ী নদের খননকাজ শুরু করা হোক এবং এ জন্য প্রস্তাবিত নকশা সংশোধনের দাবি জানান তিনি।
ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের পরিচালক রকিবুল ইসলাম জানান, বর্তমানে নদের অপর প্রান্তে ভাঙনের প্রকোপ বেশি থাকায় এই নকশা করা হয়েছে। এতে গুটিকয়েক ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সবাই উপকৃত হবে। তবে জেলা প্রশাসন যেখানে জমি নির্ধারণ করে দেবেন, সেখানে খনন করা হবে।

জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রামবাসী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সঙ্গে সমন্বয় করে খননকাজ শুরু হবে।