ভূগর্ভে নদীর বিষাক্ত পানি

গবেষণার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি দূষণ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা ও মেঘনা নদীতে।

দূষণের কবলে কর্ণফুলী। আশপাশের বর্জ্য এসে প্রতিদিনই মিশছে নদীতে। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম নগরের ফিশারিঘাট এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

দেশের প্রধান শহর ও শিল্প এলাকাগুলো সুপেয় পানির সুবিধা নিতে মূলত নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু যে নদী এসব শহর আর শিল্পকে জীবন দিয়েছে, সেখানকার পানি এখন বিষাক্ত হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে। দেশের বর্জ্যের প্রধান ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে এসব নদী এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এসব বিষাক্ত পানি নদীর সীমা ছাড়িয়ে প্রবেশ করছে ভূগর্ভে। আর ওই ভূগর্ভ থেকেই আমাদের খাওয়ার ও সেচের পানির বড় অংশের জোগান আসছে, যা খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী সব রোগের সৃষ্টি করছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভে একবার বিষাক্ত পানি প্রবেশ করলে তা পরিশোধন করা খুবই কঠিন। তাই সরকারের উচিত, নদীগুলোকে দ্রুত দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক নদী দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসটির স্লোগান, ‘মানুষের জন্য নদী।’

আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো দূষণের স্তর পেরিয়ে এখন বিষাক্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আর এগুলো ভূগর্ভে প্রবেশ করায় তা জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে।
ড. জামাল উদ্দিন, শিক্ষক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

গত ৪০ বছরে দেশের নদ-নদীগুলো নিয়ে হওয়া ২৮৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী হেলিয়ন–এ। দক্ষিণ কোরিয়ার কুমো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষক ইয়োন কো ঝিয়ং ও বাংলাদেশের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. জামাল উদ্দিন যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘গত ৪০ বছরে নগর নদীর দূষণ: সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ও প্রতিবেশগত ঝুঁকি, বিদ্যমান নীতি, পানি ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা’।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিন্তু তাতে পরিবেশ সুরক্ষা এবং বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ কম থাকছে। বিভিন্ন উৎস থেকে বের হওয়া বর্জ্যের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে পড়ে। প্রতিবেদনটিতে বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা ও মেঘনা নদীতে সবচেয়ে বেশি দূষণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ড. জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো দূষণের স্তর পেরিয়ে এখন বিষাক্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আর এগুলো ভূগর্ভে প্রবেশ করায় তা জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে। আর সরকার যখন এসব দূষণ রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তখন তা কিছুটা কমে। কিন্তু সরকারি তৎপরতা কমে এলে দূষণ বেড়ে যেতে দেখা গেছে।’

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এসব দূষিত পদার্থ নানাভাবে খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, চোখের সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগবালাই তৈরি করছে। বিশ্বের যেকোনো মহাদেশের মধ্যে এশিয়ায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। আর বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম শীর্ষে থাকা দেশ।

প্রতিবেদনটিতে দূষণের বড় উৎসগুলোর মধ্যে শিল্পবর্জ্য এবং শহরের ‍গৃহস্থালি বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রংপুর শহরের সব বর্জ্য গিয়ে পাশের নদীগুলোতে গিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া সাভারে চামড়াশিল্প নগরী, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক কারখানা, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে গড়ে ওঠা ভারী শিল্পকারখানাগুলো থেকে বর্জ্যের সঙ্গে বিপুল পরিমাণে ভারী ধাতু জমা হচ্ছে। আর সড়ক, সেতু, কালভার্টসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে শহর এলাকার নদীগুলোয় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ থাকছে। অনেক স্থানে নদী বদ্ধ হয়ে সেখানে বর্জ্যের স্তর তৈরি হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিন উদ্দিন আহমেদের ২০১৮–১৯ সালে পরিচালিত গবেষণায় ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর ভূগর্ভে ভারী ধাতুযুক্ত বিষাক্ত পানি প্রবেশ করার চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকার হাজারীবাগ, সদরঘাট, সাভার ও গাজীপুরের নলকূপ ও গভীর নলকূপের পানি তিনি পরীক্ষা করেছেন। তাঁর গবেষণায় এসব পানিতে ভারী ধাতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। ড. মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে খাবারের পানির বেশির ভাগ ভূগর্ভ থেকে তুলে জোগান দেওয়া হচ্ছে। ভূগর্ভে একবার বিষাক্ত পানি প্রবেশ করলে তা পরিশোধন করা খুবই কঠিন। তাই সরকারের উচিত নদীগুলোকে দ্রুত দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের টেক্সটাইল শিল্প থেকে ২০১৬ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ঘনমিটার তরল বর্জ্য নির্গত হয়। গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে ২০২১ সালে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটারে পরিণত হয়েছে। আর শুধু সাভারের চামড়াশিল্প নগরী থেকে দিনে ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল এবং ৩৩২ টন কঠিন বর্জ্য বের হয়ে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ে। শিল্পকারখানা দূষণের দিক থেকে পর্যায়ক্রমে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা ও সার কারখানা। এর পরেই রয়েছে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, তেল প্রক্রিয়াজাত কারখানা, ফার্মাসিউটিক্যালস ও মেটাল কারখানা।