যশোর রোডের গাছগুলো

যশোর রোডের গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা জরুরি। গত ১৩ মার্চ
ছবি: লেখক

২০০৫ সালের দুটো ছোট্ট পর্যবেক্ষণ আমাকে নাড়া দিয়েছিল। যার একটি যশোর রোড হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতা যাওয়ার পথে। বাংলাদেশ অংশের মহিরুহ শিরীষগুলোর বিবর্ণ ও হতশ্রী রূপ। অন্যদিকে ভারতীয় অংশের গাছগুলোর আভিজাত্য ও রাজসিক উপস্থিতি ছিল রীতিমতো স্বস্তিদায়ক। আরেকটি পর্যবেক্ষণ কুড়িগ্রামের বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় অংশ চ্যাংড়াবান্ধা অতিক্রম করার সময়। সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশ ততটাই ন্যাড়া, যার বিপরীতে যতটা সবুজ ভারতীয় অংশ। ঘনবদ্ধ গাছের ছায়ায় সেখানে ভরদুপুরেও যেন সন্ধ্যা নেমেছে!

যতবার বেনাপোল গিয়েছি, ততবারই ঐতিহাসিক এ বৃক্ষগুলোর জন্য বিষণ্ন হয়েছে মন। দেশের এমন একটি গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবৃক্ষগুলো আমরা রক্ষা করতে পারছি না।

১৮৪০ সালে যশোরের বকচরের জমিদার কালী পোদ্দার মায়ের গঙ্গাস্নানযাত্রা আরামদায়ক করতে নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়কটি নির্মাণ করেন। পরে ১৮৪২ সালে সড়কটি ছায়াসুনিবিড় করতে দুপাশে এ মেঘশিরীষ বা রেইনট্রিগাছগুলো লাগান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শরণার্থী শিবিরগুলো দেখে লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এ সময় তাঁর সংগীতায়োজনে বিখ্যাত গায়ক ও নোবেল বিজয়ী গীতিকবি বব ডিলানসহ অন্য সংগীতশিল্পীরা সেই কবিতা গানে রূপ দিয়ে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। এভাবেই যশোর রোড এবং সেখানকার বৃক্ষগুলো আমাদের ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অত্যুজ্জ্বল স্মারক হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব কথা আমরা এখন প্রায় ভুলতে বসেছি।

কিন্তু গাছগুলো নিয়ে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘোষণাটি আসে ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি। যশোর জেলা প্রশাসন সড়কটির দুপাশের ২ হাজার ৩১২টি গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় সেদিন। যার মধ্যে তিন শতাধিক বৃক্ষ ঐতিহ্যবাহী ও শতোর্ধবর্ষী। শুধু তা-ই নয়, নামমাত্র মূল্যে গাছগুলো বিক্রি করে লুটপাটের একটি নীলনকশাও প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু সফল হয়নি তারা। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। ১৮ জানুয়ারি বাপা, তরুপল্লবসহ মোট সাতটি সংগঠন রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। একপর্যায়ে হাইকোর্ট গাছগুলো রক্ষায় স্থিতাবস্থার আদেশ দেন।

তাৎক্ষণিকভাবে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রায় দুই বছর পর এ বছরের ১৩ মার্চ গাছগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে সেখানে গিয়েছিলাম। যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথে বিক্ষিপ্তভাবে গাছগুলো চোখে পড়ল। পরিচর্যা ও নজরদারির অভাবে ইতিমধ্যে অনেক গাছ হারিয়ে গেছে। অবশিষ্ট গাছগুলোর মধ্যে কোনোটি হেলে পড়েছে, কোনোটি উপড়ে পড়ে আছে, কোনোটিতে তৈরি হয়েছে বিশাল খোঁড়ল। এসব দেখার যেন কেউ নেই। একটি চিহ্নিত মহল চায় গাছগুলো এভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।

এ মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশেষজ্ঞ দলের অধীনে গাছগুলোর সঠিক পরিচর্যা হওয়া দরকার। নিবিড় পর্যবেক্ষণ না থাকলে অচিরেই সব গাছ হারিয়ে যাবে। পরিণত এ গাছগুলোর যে বিশাল পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে, তার ইতিবাচক দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ গাছগুলো সমবেতভাবে একটি বনের মতোই ভূমিকা রাখছে। হিসাব করলে যা ৩৬ হাজার হেক্টর বনের (কলকাতার অংশসহ) সমান হতে পারে। গাছগুলো সর্বমোট ৯ লাখ ১২ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে ছায়া দিচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গাছগুলোর বিশাল ভূমিকা রয়েছে সন্দেহ নেই।

পুরোনো এ সড়ক আগের তুলনায় এখন অনেক ব্যস্ত। সে কারণে সড়কের প্রশস্ততা ও সংস্কার জরুরি। তবে এর জন্য গাছ কাটার প্রয়োজন নেই। গাছগুলো কাটলেই সড়ক প্রশস্ত হবে না। বিকল্প হিসেবে গাছগুলো রেখে বিদ্যমান সড়কের যেকোনো এক পাশ চওড়া করা যেতে পারে। অথবা অপেক্ষাকৃত কম গতির যানবাহনগুলোর জন্য আলাদা লেন করা যেতে পারে। সড়কের দুপাশে বাড়তি জায়গা থাকায় এর জন্য আলাদা জমি অধিগ্রহণেরও প্রয়োজন নেই। উল্লেখ্য, সড়কটির কলকাতা অংশের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও গাছগুলো না কাটতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।