লাল শাপলায় রঙিন প্রকৃতি

লক্ষ্মীপুরের তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব চরমনসা গ্রামের সাহেব বাড়ির শাপলাবাগানপ্রথম আলো

‘মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!’

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার এই লাইনগুলো পাঠকদের আলোড়িত করে এখনো। কবির আকাঙ্ক্ষা ছিল তিন প্রহরের বিলে পদ্মফুল দেখার। কিন্তু বাস্তবে পদ্মবিল এখন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য। তবে কবির কাঙ্ক্ষিত পদ্মবিল কিছুটা দুর্লভ হলেও বর্ষা-শরতে আমাদের চারপাশের জলাশয়ে বিচিত্র রঙের শাপলা ফুলের দেখা মেলে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে লাল শাপলার বড় বিল দেখা যায়। শাপলা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে পর্যটকেরা ভিড় করেন।

পরিসরের দিক থেকে ঠিক ততটা বিস্তৃত না হলেও লক্ষ্মীপুরে এমনই এক জলাশয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে হাজারো লাল শাপলার উপস্থিতি নজর কাড়ে। এখানে শাপলার পাতায় প্রতিনিয়তই রঙিন প্রজাপতি আর ভ্রমরের ওড়াউড়ি ভিন্ন এক সৌন্দর্য তৈরি করেছে। আর জলচর পাখিদের লুকোচুরিও মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। সূর্যোদয়ের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ামাত্রই যেন মন উদাস করা এক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয় পূর্ব চরমনসা গ্রামটি। এ ছাড়া গোধূলিলগ্নে মনে হয় যেন মেঘমালার রাজত্বে রূপসীদের মিলনমেলা। সেই দৃশ্য অবলোকনে দর্শনার্থীদের সঙ্গে প্রকৃতিও যেন অপার আনন্দে মেতে ওঠে।

লক্ষ্মীপুর শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব চরমনসা গ্রামে ‘সাহেববাড়ির শাপলাবাগানের’ অবস্থান। ওই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম নামের কলেজশিক্ষক লাল শাপলার কিছু কন্দ এনে লাগিয়েছেন দুই বছর আগে। তিনি বরিশাল থেকে মোথাকন্দগুলো এনে প্রায় ১৫০ শতাংশ জমিতে পুকুর খনন করে লাগিয়েছেন। তার পর থেকে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে গাছগুলো। সেখানেই এখন ফুটেছে হাজারো লাল শাপলা। ভাবনার দিক থেকে জাহাঙ্গীর আলমের এ উদ্যোগকে অনেকটা ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে।

অতিসম্প্রতি শাপলাবাগানে গিয়ে দেখা যায়, এক পাশে সুপারি-নারকেলবাগান, অন্য পাশে শাপলার লোহিত হাসি। প্রথম দেখাতেই মন কেড়ে নেয় সেই দৃশ্য। অপরূপ সেই দৃশ্য দেখে ভীষণ মুগ্ধ হবেন যে কেউ। যত দূর চোখ যায়, শাপলা ফুলের মনোমুগ্ধকর শোভা নজরে পড়ে! ওই গ্রামের মানুষ জলে ফোটা শাপলাগুলোকে তাঁদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। শাপলার নরম পাপড়ির স্পর্শেই তাঁরা মোহিত হয়ে পড়েন। শরতের মৃদু হাওয়ায় শাপলার কাঁপনে মন ভরে যায় গ্রামবাসীর।

সকাল আটটার দিকে রোদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই গ্রামের যুবক মো. ফয়সাল জানান, এখন শাপলা ফুলের ঘুমানোর সময়। কথা শুনে চমকে উঠলাম। সত্যি কি তাই? ভালো করে লক্ষ করলাম, ফুলগুলো নেতিয়ে পড়ছে। জলের ওপর সূর্যের সোনালি রোদ পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়তেই শাপলারা নিজেকে যেন গুটিয়ে নিতে শুরু করল। শাপলা ফুল সাধারণত রাতে জেগে থাকে।

পূর্ব চরমনসা গ্রামের যুবক মো. ফারুক বলেন, ‘দুই বছর আগে এখানে শাপলা ফুল আবাদ করা হয়। আমরা এগুলো দেখাশোনা করি। কাউকে ফুল তুলতে দিই না, অনেক যত্ন করে রাখি। অনেক দূর থেকে এসে লাল শাপলা ফুলের ছবি তোলেন ফুলপ্রেমীরা।’

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাইয়াজ হোসেন জানায়, সে প্রথমে বইয়ে শাপলা ফুল দেখেছিল। এখন বাস্তবে দেখছে, নিজের গ্রামেই এমন বাহারি শাপলা ফুল আছে, যা দেখে সে খুব খুশি। প্রতিদিন সকাল-বিকেল এখানে এসে শাপলা ফুল দেখে সে।

লক্ষ্মীপুর শহর থেকে লাল শাপলা ফুল দেখার জন্য এসেছেন মো. সুমন ও মো. মামুন। তাঁরা বলেন, ‘এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। আমাদের চারপাশে এমন উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন।’