লেজনাচুনে নেচে যা

কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের ঝাউবনে লেজনাচুনে পাখি
ছবি: এস আই সোহেল

দুটি পিচ্চি ছানা নিয়ে বেজি দম্পতি খাবার সন্ধানে ঘুরছে গ্রামীণ বনটাতে। একটি জলশূন্য ডোবার ভেতরে নামতেই আচমকা একটি ছানা আক্রান্ত হলো একটি পাখির নিঃশব্দ ডাইভে।পাখিটির ধারাল নখরের আঁচড় ও চাপ খেয়ে ভয়ে ভ্যাবাচেকা ছানাটি ভয়ার্ত চিৎকার দিয়ে উল্টে পড়ল, এতক্ষণে শূন্যে থাকা পাখিটি উড়ে-ঘুরে প্রচণ্ড শব্দে গালাগাল ঝাড়তে শুরু করল। পাখিটির সঙ্গীও দ্রুত বেগে উড়ে এল ডাকতে ডাকতে। এরপরে দুটিতেই দুই পাশ থেকে পরিকল্পিত দর্শনীয় ডাইভ দিতে শুরু করল। বেজিগুলো একটা ঘন ঝোপের তলায় আত্মগোপন করল।

লেজ-পাখার সৌন্দর্যের চেয়ে এদের ‘মাটির চায়ের কাপের’ আকৃতির বাসাটির সৌন্দর্যও মুগ্ধ করার মতো। ছিমছাম বাসাটির বাইরের দিকে এরা মুখের লালা ও মাকড়সার জালের মিশ্রণে তৈরি তরল দিয়ে যেন প্লাস্টার করে দেয়।

এইটুকু দেখে বাগানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে খবরটা জানালেন আমার এক মামি। বাগানে ঢুকেছিলেন তিনি গাছ থেকে খসে পড়া সুপারিপাতা কুড়াতে। ঘটনাটি গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের। সঙ্গে সঙ্গে ওই বাগানটিতে ঢুকলাম। পাখিটির বাসা যে একটি ডোবার পাড়ের কাগজিলেবুর গাছের সরু দুলন্ত-ঝুলন্ত ডালে, সেটা আমি দেখেছি, সে বাসায় তিনটি ডিম, পালা করে তা দিচ্ছে স্বামী-স্ত্রী মিলে। আমার হিসাবে ডিম ফুটবে আর মাত্র চার–পাঁচ দিন পরে। এদের ডিম ফুটে ছানা হয় ১২-১৫ দিনে।

ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি এলাহি কাণ্ড! ঘনবুনটের ঝোপটি ঘিরে ১৫–২০টি পাখি অস্থির ওড়াউড়ি-ঘোরাঘুরি করছে আর মিছিল-স্লোগানসহকারে ঝোপটিতে আক্রমণ করতে চাইছে। এই মিছিলে আছে দুটি শ্যামা, দুটি বুলবুলি, একটি দুধরাজ, একটি দোয়েল ও তিনটি নীলরাজা বা মালাটুনি। অনতিদূরে চেঁচাচ্ছে ছাতারের ঝাঁক। আমি ঝোপটির পাশে গিয়ে হাততালি দিলাম, সঙ্গে সঙ্গে চারটি বেজি ভোঁ–দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ‘ধর ধর’ স্লোগানে পাখিগুলো ধাওয়া করল বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত।

এই পাখিটিকে চিনি আমি শৈশব থেকে। দেখেছি এদের দুর্দান্ত ডাইভ। দুঃসাহসী পরিকল্পিত আক্রমণে এরা সাপ-বনবিড়াল-শিয়াল-পোষা কুকুর, বিড়ালসহ গুইসাপকে ভড়কে দিতে পারে। শ্যামার মতো এদেরও পছন্দ ‘ছায়া ছায়া-মায়া মায়া’ বন-বাগান, মূল খাবার উড়ন্ত নানা রকম পোকামাকড়। সুযোগ পেলে মাটিতে নেমে উইপোকা ও ওদের পোলাওয়ের চালের মতো ডিমও খায়।

সুদর্শন বাহারি লেজের অধিকারী ও চঞ্চল-চতুর ধূসর-কালো রঙের পাখিটির নাম ‘লেজ নাচুনে’। সার্থক নাম এদের। গলাটা তুলোট সাদা, চোখের ওপর দিয়ে সাদা টান, ঠোঁট-পা কালো। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির রং বাদামি, গলায় কালচে ছিট ছোপ থাকে। এদের বাসার কাছাকাছি গেলেই এরা আক্রমণে আসবেই।

এদের সব সৌন্দর্য যেন লেজের সুবিন্যস্ত ১২ খানা লম্বা লম্বা পালক। পালকগুলোর প্রান্তদেশ আবার সাদা। এদের ১২ খানা পালক মেলে দিয়ে এরা যখন আনন্দ-ফুর্তিতে ডালে ডালে লম্ফঝম্ফ করে ও ‘হুহচি লুহচি’ শব্দে গান করে, ডাকাডাকি করে, তখন দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। মেলে দেওয়া লেজের পালকের পাখার সঙ্গে অনেকটাই মিল পাওয়া যাবে জাপানি হাতপাখার। প্রেম মৌসুমে পুরুষটির নৃত্যগীত ও লেজ-পাখার ডিসপ্লে থামতেই চায় না। অপূর্ব তাল-লয় ও ছন্দে ঘুরে ঘুরে নাচে। পাখা মেলে দিয়ে লেজের সঙ্গে তাল ঠিক রেখে নাচে। এই পাখিটির দেখা সারা দেশেই মিলবে। লেজ-পাখার সৌন্দর্যের চেয়ে এদের ‘মাটির চায়ের কাপের’ আকৃতির বাসাটির সৌন্দর্যও মুগ্ধ করার মতো। ছিমছাম বাসাটির বাইরের দিকে এরা মুখের লালা ও মাকড়সার জালের মিশ্রণে তৈরি তরল দিয়ে যেন প্লাস্টার করে দেয়। লেজনাচুনের আরও কিছু নাম আছে, ছাতাঘুরানি, চাক দোয়েল ও লেজপাখা। ইংরেজি নাম White Throated Fantail। বৈজ্ঞানিক নাম Rhipidura albicollis। দৈর্ঘ্য ১৭ সেন্টিমিটার।