শত বছরের ধূপগাছ

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন খাসিয়াপুঞ্জিতে শতবর্ষী ধূপগাছ
ছবি: প্রথম আলো

ধূপ–ধুনার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুরোনো। একসময় সন্ধ্যায় ধূপ পুড়িয়ে ঘরময় সুগন্ধ ছড়ানোÑছিল গৃহলক্ষ্মীদের নিয়মিত একটি কাজ। গোয়ালঘরে ধূপ ছিটিয়ে নারকেলের ছোবড়া জ্বালিয়ে সুগন্ধি ধোঁয়ায় মশা তাড়ানো হতো। দোকানেও পোড়ানো হতো এই ধূপ।

এখনো কোথাও হয়তো এই প্রচলন আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এখন সেই জায়গা নিয়েছে ধূপকাঠি। এটি ধূপ–ধুনারই কাঠিসংস্করণ। তবে পূজা-অর্চনায় এখনো ধূপ পোড়ানোর রীতি টিকে আছে। এই সুগন্ধি ধূপ আসে গাছ থেকে প্রাকৃতিকভাবে। গাছটির নামই ধূপগাছ।

আরও অনেক গাছের মতো এই ধূপগাছও আগে বনেবাদাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছে। কিন্তু বনবাদাড় উজাড় হওয়ায় ধূপগাছের বংশবিস্তার কমেছে। ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষিত ও নিরাপত্তা) আইনে ধূপগাছ সংরক্ষিত উদ্ভিদ। ধূপগাছ আমাদের দেশে বিরল প্রজাতির একটি উদ্ভিদ। তবে বিরল সত্ত্বেও কিছু গাছ এখনো টিকে আছে। তার একটির বয়স এখন শত বছর। শতায়ু গাছটির অবস্থান মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন খাসিয়াপুঞ্জিতে। পুঞ্জির পানজুম ও বসতির কাছে শত বছর ধরে গাছটি ফুল–ফল ও পাখিকে আশ্রয় দিচ্ছে। গোল ও পুরু বাকলের শরীর নিয়ে সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে গাছটি। শরীরভরা খাঁজ ও ফাটল। ক্ষতস্থানে কষ বেরিয়ে আসার চিহ্ন। ঝাঁকড়া ডালপালা, সবুজ পাতার ছাউনি।

লাউয়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা হাতিম আলী লংডের বয়স ৭৩ বছর। ৫৭ বছর ধরে পুঞ্জিতে আছেন তিনি। তাঁর কথায়, গাছটিতে ফল ধরলে ধনেশ পাখি আসে। ধনেশ পাখি ধূপগাছের ফল বেশি খায়। তিনি জানান, গাছটি নিয়ে গবেষণা করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসেছেন। বন বিভাগের গবেষকেরাও দেখেছেন। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আরও ১০ থেকে ১৫টি গাছ দেখেছেন তিনি। তবে সেগুলোর বয়স কম। গাছটির বেড় প্রায় সাড়ে ৯ ফুট এবং উচ্চতা ১০০ ফুটের মতো হবে।

তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই জানতেন না গাছটির পরিচয়। তেমন একজন সাজু মারচিয়াং। লাউয়াছড়া পুঞ্জির এই বাসিন্দা বলেন, ‘এটি যে ধূপগাছ তা জেনেছি গবেষকেরা আসার পর। পূজার সময়ে চা-বাগানের শ্রমিকদের এই গাছের কষ নিতে দেখতাম।’

ধূপগাছ মাঝারি আকৃতির বিস্তৃত ডালপালার চিরসবুজ গাছ। গাছের গুঁড়ি ও কাণ্ড সরল–সোজা ও নলের মতো গোল। বাকল পুরু, ধূসর রঙের ও সুগন্ধিযুক্ত। বাকলে খাঁজ ও ফাটল রয়েছে। গুঁড়ি বা কাণ্ড কাটা হলে বাদামি বা কালো রঙের আঠা বেরিয়ে আসে। এই আঠা শুকিয়ে ধূপ তৈরি করা হয়। জুন-জুলাই মাসে কিছুটা হলুদ, হালকা সাদাটে ফুল ফোটে। ফল ডিম আকারের। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পরিপক্ব ফল নীলচে কালো থেকে গাঢ় ধূসর হয়ে ওঠে। ফলের ভেতরটা মাংসল ও ঘ্রাণ মিষ্টি। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বন এলাকায় ধূপের বীজ থেকে গাছ জন্মে। ধূপগাছ দেশের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলের মিশ্র চিরসবুজ বনের ঢালে জন্মে।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা রফিকুল হায়দার জানান, গাছের বয়স জানার একটি পদ্ধতি আছে। সেটি গাছ কেটে গাছের ভেতরের রিং দেখে বোঝা যায়। গাছটির বয়স শত বছর হবে। এই ধূপগাছ নিয়ে তাঁর রয়েছে একটি রোমাঞ্চকর স্মৃতি। বছর দশেক আগে মৌলভীবাজারের আদমপুর বনে কাজ শেষে দুপুরে একটি গাছের নিচে বসে খাবার খাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখেন সেই গাছের নিচে কষজাতীয় কিছু পড়ে আছে। সেখান থেকে ধূপের মতো ঘ্রাণ আসছে। গাছ চেনেন এমন একজনের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে কথা বলেন তিনি। নিশ্চিত হন এটিই ধূপগাছ। সেখান থেকে নমুনা নিয়ে যান ও বীজ সংগ্রহ করেন। পরে বীজ থেকে চারা করার গবেষণায় নামেন। প্রথমে সফল না হলেও ২০০৮-২০০৯ সালের দিকে চারা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধূপগাছ লাগানো হয়েছে।