শতদাগি ঘাসপাখির মৌসুম

শতদাগি ঘাসপাখি। কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর কালির চর, ২৮ আগস্টছবি: মো. আবু তাহের

সারা দেশে বড় বন্যা হয়েছে। কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর কালির কোল অংশের একটি চর এর মধ্যেও জেগে আছে। চরটির কিছুটা অংশে ছোট্ট একটি ঘাসবন। জায়গাটা উঁচু হওয়ায় তলিয়ে যায়নি। গত ২৮ আগস্ট পাখি দেখিয়ে আবু তাহের এই ঘাসবন থেকে একটি পাখির ছবি ক্যামেরাবন্দী করেন। পাখিটির নাম ব্রিসেলের ঘাসপাখি বা শতদাগি ঘাসপাখি। পাখিটির চলাফেরা দেখে মনে হয়েছিল চরটিতে তার বাসা আছে। পাখি গবেষকদের কাছে নিশ্চয়ই এটি ভালো খবর।

২০১৪ সালের এপ্রিল মাস। টাঙ্গুয়ার হাওরের নলবনে পাখির পায়ে রিং পরানোর কাজে গিয়েছিলেন ইনাম আল হক। সে সময় ছয়টি ব্রিসেলের ঘাসপাখিকে রিং পরিয়েছিলেন। প্রায় ১০০ বছর পর এ পাখি প্রজাতির পুনরায় দেখতে পাওয়ায় সে সময় বাংলাদেশে হইচই পড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে এখন নিয়মিতই দেখা যায় পাখিটি।

বাংলাদেশে মাত্র ১০ জাতের পাখি আছে, যারা বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন। এর মধ্যে দুই জাতের পাখি শুধু আমাদের দেশে পরিযায়ন করে সংসার সাজানোর জন্য। গ্রীষ্মে আসে এই শতদাগি ঘাসপাখি। আমাদের দেশে ঘাসবন আছে বলেই তাদের এই আগমন। এ জাতের পাখির প্রজননকাল মূলত এপ্রিল-জুন মাস। তাই তো কালিয়ার চরে শতদাগি ঘাসপাখি বাসা দেখার খবর শুনে একটু অবাকই হয়েছি! আগস্টের শেষভাগেও তাদের সরব উপস্থিতি।

শতদাগি ঘাসপাখি খুবই মূল্যবান একটি ঘাসপাখির জাত। গবেষকবন্ধু সায়েম ইউ চৌধুরী ও তাঁর দলের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রজননের জন্য এই প্রজাতির পাখির একটি বড় ভূমি হলো বাংলাদেশ।

শতদাগি ঘাসপাখি খুবই মূল্যবান একটি ঘাসপাখির জাত। গবেষকবন্ধু সায়েম ইউ চৌধুরী ও তাঁর দলের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রজননের জন্য এই প্রজাতির পাখির একটি বড় ভূমি হলো বাংলাদেশ। এখন এই পাখিকে পদ্মা-যমুনা নদীর চরের ঘাসবনগুলোতে ভালোই দেখা যায়। নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানেও এদের দেখা মেলে। তবে সংখ্যায় বাংলাদেশের মতো নয়।

পৃথিবীতে মাত্র ১০ হাজার শতদাগি ঘাসপাখি টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে এর সংখ্যা ৫০০-র কোটায়।

বাংলাদেশে এই পরিবারের ঘাসপাখি মাত্র তিনটি। একটি হলো স্ট্রেইটেট গ্রাসবার্ড বা দাগি ঘাসপাখি। এই প্রজাতি খুব সহজেই দেখা যায়। হাওর বা নদীচরে গেলে সারা দিন এই পাখির ডাক শোনা যায়। আর অন্যটি হলো ব্রিসেলের ঘাসপাখি বা শতদাগি ঘাসপাখি। এই দুই প্রজাতির মধ্যে দারুণ মিল আছে। খালি চোখে দেখলে একে শনাক্ত করা বেশ কঠিন। তবে ডাক শুনে এদের সহজেই আলাদা করা যায়। হয়তো এ কারণেই এই পাখিকে শনাক্তকরণ এ দেশে ঠিকভাবে হয়নি। আর সবশেষ প্রজাতিটি হলো বাংলা ঘাসপাখি।

ঘাসবনে মোট কত জাতের পাখির বসবাস, তার একটি তথ্য আমাদের হাতে আছে। শতাধিক জাতের পাখি এসব ঘাসবন বা নলবনে দেখা যায়। নদীচরের এই ছোট ছোট জঙ্গল না থাকলে এই পাখিগুলো তাদের আবাস হারাবে।

আমাদের দেশে হাওর ও নদীগুলোতে যে ঘাসবন দেখা যায়, তার মূল্য সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কেউই আমরা ভালো বুঝি না। শীতের শেষ থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ঘাসবনগুলো সামান্য লাভের আশায় কেটে ফেলা হয়। বেশির ভাগ মানুষ ব্যবহার করে জ্বালানির কাজে, ঘর তৈরির উপকরণ হিসেবে এবং কোনো কোনো সময় পানের বরজ তৈরি করতে।

করোনাকালে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এবার ঘাসকাটিয়েরা বিপদে পড়ে যায়। ঘাসের দাম নেই বললেই চলে। এক নৌকা ঘাস কোনো কোনো জায়গায় মাত্র ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ফলে ঘাস কাটা কিছুটা কমেছে এ বছর। এর ভালো সুবিধা পেয়েছে ঘাসপাখিরা।

ঘাসপাখি যেকোনো পাখির তুলনায় খুবই মূল্যবান। ঘাসবনসহ ফসলের মাঠে এই পাখি না থাকলে কৃষকের শস্যের ফলন একেবারেই কমে যাবে। ঘাসবনে যেসব পাখি দেখা যায়, তারা মূলত পোকা খায়। প্রতিদিন অসংখ্য পোকা খেয়ে এই পাখিরা আমাদের কী উপকার করছে, তা অনুমান করা শক্ত।

ঘাসপাখি আছে বলেই কিন্তু আমাদের চরগুলোতে বন জন্মাচ্ছে। চরগুলো শক্ত ও উর্বর হচ্ছে। আমরা শুধু ঘাসবনগুলো ধ্বংসই করছি, তৈরি করছি না। ঘাসবনগুলো অবহেলায় একদিন পাখিশূন্য বন হোক, তা আমরা কেউই দেখতে চাই না। আর তা হলে পাখির চেয়ে মানুষের ক্ষতিই বেশি হবে।