শীতলক্ষ্যায় পালতোলা নাও

দীর্ঘ এক যুগ পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে চলছে পালতোলা নৌকা। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের কদমতলী ঘাট এলাকায়।  ছবি: দিনার মাহমুদ
দীর্ঘ এক যুগ পরে শীতলক্ষ্যা নদীতে চলছে পালতোলা নৌকা। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের কদমতলী ঘাট এলাকায়। ছবি: দিনার মাহমুদ

শরতের নীল আকাশে শুভ্র মেঘ তুলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘের ছায়া এসে পড়েছে শীতলক্ষ্যার টলটলে জলে। কয়েকজন যাত্রী নিয়ে নাও (নৌকা) ভাসিয়েছেন বৃদ্ধ মাঝি। লগির ভরে নাও ভাসতেই ছোট রশিতে হ্যাঁচকা টানে মাস্তুলে বাঁধা পাল খুলে দেন। দক্ষিণের হাওয়া এসে দোলা দেয় পালে। বইঠায় হাল ধরেন মাঝি। শরতের আকাশের দিকেই যেন তিরতিরিয়ে এগিয়ে যায় নাও।

প্রায় এক যুগ পর এমন দৃশ্যের দেখা মিলছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে। লক্ষ্যার বুকে প্রতিদিনই ভাসছে হারিয়ে যাওয়া পালের ডিঙি। এসব নৌকা দেখতে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকার শীতলক্ষ্যার হাফিজ জুট মিল ঘাট থেকে বন্দর মাহমুদ নগর ঘাট পারাপারে নৌকাগুলোর ব্যবহার হচ্ছে। ২৭ আগস্ট দুপুরে এমন একটি নৌকায় নদী পার হতে হতেই কথা হয় মাঝি আবুল হাসেমের সঙ্গে। এই ঘাটে ৩০ বছর ধরে নৌকা বাইছেন তিনি। এ বছর শীতলক্ষ্যায় স্রোত বেশি, তাই নদী পারাপারের কষ্ট থেকে বাঁচতে মাঝিরা পাল ব্যবহার করছেন বলে জানান আবুল হাসেম। তিনি জানান, দুই মাস ধরে এই ঘাটের ১৬টি নৌকা পাল ব্যবহার করে যাত্রী পারাপার করছে। প্রায় ১২ বছর আগে শেষবার পাল ব্যবহার করেছিলেন এই ঘাটের মাঝিরা। নদীর পানি কমে যাওয়ায় তারপর আর পাল ব্যবহার করতে হয়নি। হাসেম মাঝির মতে, ‘ভরা গাঙ্গেই বাদামের সৌন্দর্য। মরা গাঙ্গে বাদাম খাটে না।’ ভাদ্র মাসের শেষে নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল নামিয়ে ফেলবেন তাঁরা। 

হাসেম মাঝির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই নৌকা এসে ভেড়ে হাফিজ জুট মিল ঘাটে। লোকসানের কারণে মিলটি বন্ধ হলেও সময়ের সাক্ষী হয়ে আছে ইটে বাঁধানো জুট মিলের ঘাট। সেই ঘাটে গাছের ছায়ায় বসে আছেন আরও কয়েকজন মাঝি। তাঁদেরই একজন খোকন মিয়া। ২০-২৫ বছর আগেও বছরের অর্ধেক সময় স্রোত থাকত শীতলক্ষ্যায়। তখন বছরে ছয় মাস নদীতে ভেসে বেড়াত রংবেরঙের পালতোলা নৌকা। তারও আগে বড় বড় পাল তুলে সাম্পান আর মহাজনি নাও ভিড়ত ঘাটে। সবই মনে আছে খোকন মাঝির। পুরোনো দিনের কথা মনে করতেই আক্ষেপ ঝরে পরে তাঁর কণ্ঠে। নদীর দুই পাড়ে তখন পাটকলের শ্রমিকদের ব্যস্ততা ছিল। নদীতে টলটলে পানি আর মাঝিদের কণ্ঠে ছিল গান। পাট আর নদীর সঙ্গে মাঝিরা হারিয়েছেন অনেক কিছু। তাঁদের কণ্ঠে তাই নদী বাঁচানোর আহ্বান।

ছেলেবেলায় গ্রামের দৃশ্য আঁকতে গিয়ে পালতোলা নৌকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন সরকারি তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী ফারহানা মানিক। বন্ধুদের সঙ্গে পালতোলা নৌকায় ঘুরতে এসে বলেন, ‘বইপুস্তকে পড়েছি নদীমাতৃক বাংলায় বর্ষার রূপ মানেই ছিল নদীর বুকে নানান রঙের পালতোলা নৌকা আর মাঝির দরদি কণ্ঠের ভাটিয়ালি। এখন পালের জায়গা দখল করেছে ইঞ্জিনের নৌকা। যন্ত্রের বিকট শব্দ কেড়ে নিয়েছে মাঝির কণ্ঠের ভাটিয়ালি।’