সবুজ বনের আলতাপরি

সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে আলতাপরি।ছবি: লেখক

‘আলতাপরি’ অপরূপ রূপের পাখি। জানা নেই, সুন্দর এ বাংলা নামটি কে দিয়েছিলেন। তবে তাঁর প্রতি রইল হৃদয় থেকে ভালোবাসা। দেশের খ্যাতিমান প্রকৃতিবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে যখনই পাখি নিয়ে কথা হতো, তিনি আলতাপরির কথা ও গল্প বলতেন। তিনি প্রকৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন পাথাড়িয়া পাহাড়ের পাখির রূপ দেখেই। সম্ভবত আলতাপরি সেই পাখিদের মধ্যে একটি, যার মধুর সুরের গান ও সৌন্দর্যে তিনি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন ছেলেবেলায়। তাঁর লেখায়ও আছে আলতাপরির কথা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাথাড়িয়া পাহাড়ের গাছপালায় তিনি প্রায় প্রতিদিনই আলতাপরি দেখতেন।

আলতাপরির আরও কয়েকটি বাংলা নাম আছে। ‘সিঁদুরে সাহেলী’, ‘লাল সাতসাহেলী’ এর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত নাম। পুরুষ পাখিটি গাঢ় সিঁদুরে লাল পালকের জন্যই নজরকাড়া। তবে স্ত্রী পাখিটির সৌন্দর্য পুরুষ পাখিটির চেয়ে মোটেও কম নয়। তারও আছে গাঢ় হলুদের কমনীয়তা। বনের সবুজে এরা উভয়ই অনিন্দ্য রূপের অধিকারী। ঘন বনের সবুজ পাতার মধ্যে এ উজ্জ্বল রঙের পাখি দুটি আপনার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা কেড়ে নিতে চাইবে।

আলতাপরির সঙ্গে প্রথম দেখা ২০০৮ সালে মৌলভীবাজারের বিলাশছড়া অরণ্যে। তারপর বনে বনে ঘুরে যতবারই দেখা হয়েছে, সেটি ছিল পুরুষ পাখি। তবে সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে গিয়ে দেখা হলো পুরুষ–স্ত্রী জোড়ার সঙ্গে।

বনের মাঝারি ও উঁচু গাছের ডালে ডালে আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছিল এরা। এক গাছ থেকে অন্য গাছে যেতে, উড়ন্ত অবস্থাতেই কীটপতঙ্গ ধরে খাওয়া এবং মাঝেমধ্যে খানিকটা বিরতি। এই বিরতির মধ্যে কয়েকবারই পাখি দুটি প্রায় কাছাকাছি এসে বসছিল। একসঙ্গে এই দুই রাজকীয় রঙের আলতাপরিকে ফ্রেমে ধরার সুযোগ খুব কমই আসে। অনেক চেষ্টা করে কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছিলাম। মেয়ে পাখিটির চালচলন দেখে মনে হয়েছে, সে অপেক্ষাকৃত লাজুক। পাতার আবডালে থাকতেই পছন্দ করে এবং কিছুটা ধীরগতির। পুরুষ পাখিটি চঞ্চল প্রকৃতির।

আলতাপরি ( Pericrocotus speciosus) বিশেষ করে সিলেট, মৌলভীবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে, মধুপুর বন ও সুন্দরবনে বসবাস করে।

আলতাপরি ( Pericrocotus speciosus) বিশেষ করে সিলেট, মৌলভীবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে, মধুপুর বন ও সুন্দরবনে বসবাস করে। আমাদের দেশের বনে আলতাপরিদের সংখ্যা এখন কেমন, তা নিয়ে জানামতো কোনো গবেষণা হয়নি। দেশের বনের পাখি নিয়ে গবেষণার অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণা প্রকল্প ও আর্থিক সহায়তা না থাকায় গবেষকেরা কাজ করতে পারছেন না।

প্রধানত চিরসবুজ বন আলতাপরিদের পছন্দ। মাঝেমধ্যে বনের পাশের লোকালয়ে চলে আসে, তবে মগডালে বিচরণ করে উড়ে যায় বনে। এরা পতঙ্গভুক পাখি এবং পোকা ধরতে নানান কৌশল অবলম্বন করে। আলতাপরি প্রজনন মৌসুমে মাকড়শার জাল, লাইকেন, মস ও চিকন আঁশ দিয়ে গাছের ডালে গোলাকার বাটির মতো বাসা বানায়। দুই থেকে তিনটি নীল-সবুজ রঙের ডিম দেয়। ছানাদের বড় করে তুলতে দুজনই অপরিসীম অবদান রাখে। ভারত, চীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বনেও এদের দেখা যায়।