সাতছড়ির পাখিবান্ধব বুনো মান্দার

সাতছড়ি অরণ্যে বুনো মান্দার ফুলের কুঁড়ি খেতে আসা ঝুলন টিয়াছবি: লেখক

মাঝেমধ্যে নির্জন কোনো সবুজ বনের পথ দিয়ে হেঁটে চলার সময় দেখা হয়ে যায় হলুদ কিংবা লাল রঙের ফুলে ভরা কোনো বৃক্ষের সঙ্গে। বনতল থেকে ওপরের দিকে তাকালে ডালপালাসহ ফুলের বিন্যাস অপূর্ব লাগে। মনকে আবিষ্ট করে তোলে সেই রূপধারা। সাদা কিংবা নীল আলোর আকাশের নিচে বেড়ে ওঠা বনে এ রকম অনেক বৃক্ষ রয়েছে, যাদের ফুলের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে মানুষের মনকে। হবিগঞ্জের সাতছড়ি অরণ্যে দুবার এ রকম দুটি প্রজাতির বৃক্ষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ফুলের রং এবং গাছভরা ফুলের বিন্যাসে ছুঁয়ে গেছে মন। তাদের একটি বনচালতা, সে বনে নিজেকে মেলে ধরে হলুদ রঙের ঝরনাধারায়। অন্যটি বুনো মান্দার, সে শাখায় শাখায় গাঢ় লাল বর্ণের ফুল নিয়ে জেগে ওঠে বনের মধ্যে। অবিরামভাবে ফুটতে থাকে ফুল, প্রায় দুই মাস থাকে তার ক্রমাগত প্রস্ফুটন।

সাতছড়ি অরণ্যর সব মধুপায়ী পাখি তখন বনের বুনো মান্দারগাছে দিনভর সময় কাটায়। ভোরের আলোর আভা পুরোপুরিভাবে ফোটার অনেকটা আগেই পাখিরা চলে আসে গাছটিতে। ফুলের মধ্যে বসবাস করা পোকামাকড় খেতে আসে নানা প্রজাতির পতঙ্গভুক পাখি। টিয়া প্রজাতিরা আসে ফুলের কুঁড়ি ও পুষ্প খেতে। প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির উপস্থিতি দেখা গেছে এ মান্দারগাছে যখন ফুল ফোটে। তা ছাড়া অনেক পাখি, যারা পান্থ বা পরিযায়ী, তারাও চলার পথে এ মান্দারগাছে সময় কাটিয়ে যায়। খাবার খায়, এমনকি কিছুদিন থাকেও। এ রকম পাখি প্রজাতি প্রতিবছর ফুলের মৌসুমে দেখা যাচ্ছে সাতছড়ির মান্দারগাছে কয়েক বছর ধরে।

বন বিভাগ সাতছড়ি বনের মধ্যে পর্যটকদের জন্য একটি টাওয়ার নির্মাণ করার পর এত প্রজাতির পাখির আনাগোনা হয় এই গাছে, সেটি জানা গেছে। কারণ, গাছটি টাওয়ারের কাছে। কাছাকাছি আরও একটি গাছ আছে। বনতল থেকে উঁচু গাছের শাখায় বসা পাখির দেখা পাওয়া ও গোনা মুশকিল। টাওয়ার থেকে পুরো গাছটির সব ডালাপালা দেখা যায় এবং ছবি তোলারও ভালো সুযোগ হয়। বনে যদি এ রকম গাছ থাকে, তাহলে পাখি ও পাখি গবেষকদের জন্য উপকার হয়।

বুনো মান্দার পাহাড়ি বন, গ্রামের ঝোপঝাড়ে, আবাদি জমির আশপাশে জন্মে। আমাদের পাহাড়ি বনে বুনো মান্দার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে বনের একটু খোলা প্রান্তরে। পাহাড়ি নদী ও পাহাড়ি ছড়ার আশপাশেও দেখা যায়। সমতলে এটি কমই পাওয়া যায়, ঝোপঝাড় বিন্যাসের ফলে কমে গেছে। এটি একটি পাখিবান্ধব গাছ।

শত শত বুনো পাখি খাবারের জন্য এ গাছের ওপর নির্ভরশীল। বনবাসী মেটে টুপি ছোট কাঠকুড়ালি পাখির খাওয়ার উপযোগী একপ্রকার শুঁয়াপোকা এ গাছের কাণ্ডে বসবাস করে। এ পাখির বাসায় ডিম ফুটে ছানা হলে ছোট কাঠকুড়ালিছানাদের খাবারের একটি বড় অংশ এ গাছের কাণ্ড থেকেই পাওয়া যায়।

বুনো মান্দার (Erythrina Variegata) মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। প্রায় ২৭ মিটার লম্বা হয়। কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখা কাঁটা দ্বারা বর্মকৃত। পাতা ত্রিফলা যুক্ত। শীতে পাতা ঝরে যায়। বসন্তে ফুল আসে। পুষ্প রেসিম, শাখার শীর্ষে জন্মায়। মঞ্জরিপত্র ত্রিকোণাকার। পাপড়ি উজ্জ্বল লাল, চওড়া ও অসম। পুংকেশর লম্বা। ফল নলাকার, ১২-১৫ সেমি লম্বা, মাঝে খাঁজ থাকে। কাঠ নরম, যে কারণে সাধারণত জ্বালানিকাজে ব্যবহার করা হয়। পাতা ও বাকলে ঔষধিগুণ রয়েছে। ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান কোড়ালট্রি। ভারতীয় উপমহাদেশের বন্য প্রজাতি। পৃথিবীর নানা দেশে শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষ হিসেবে লাগানো হয়েছে। মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ানো জন্য এ গাছ উপকারী।

সৌরভ মাহমুদ, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক