সুন্দরবনকে পরের ঝড়ের জন্য তৈরি করতে হবে

দ্বাররক্ষী দেখতে যতই ষণ্ডা–গুন্ডামার্কা হোক, মালিককে তাঁর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখতে হয়। সুন্দরবনের স্বাস্থ্য নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।

রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের খড়্গ মাথায় নিয়ে সুন্দরবন ভালো নেই, এটা আমাদের সবার জানা। তবে এর বাইরেও সুন্দরবন নানা সমস্যায় জর্জরিত।

বছর বছর ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনকে দুর্বল করে দিয়েছে। এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে আগের ঝড়গুলোর মতো গাছপালার তেমন ক্ষতি হয়নি, তবে প্রাণিসম্পদের যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আর হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঝড়ের কথায় পরে আসি। ধারাবাহিকভাবে প্রাণিসম্পদের নির্বিচার ক্ষতি করে চলেছে লোভকাতুর দুষ্ট মানুষের দল।

সুন্দরবনের ভেতরের নদী আর জলধারাগুলো বাণিজ্যিক জাহাজ বা কার্গোর জন্য যত কম ব্যবহার করা যায়, প্রাণিসম্পদের জন্য তত ভালো। কিন্তু দিন দিন পরিবহন ব্যবসায়ীরা যেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এর ওপর আছে রহস্যজনক আগুনের তেলেসমাতি। বিগত দুই দশকে ২৩ বার বড় ধরনের আগুন লেগেছে সুন্দরবনে, বিশেষ করে পূর্ব সুন্দরবনে। কেউ কি ভেবেছেন, কেন পূর্ব সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগে?

ট্যাংকার আর জাহাজডুবি

সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগামারী এলাকায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তলা ফেটে ডুবে যায় ‘এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামের জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার। যেখানে জাহাজটি ডুবে যায়, সেটি ছিল বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম। পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব গভীর সংকটে পড়ে।

এসব নিয়ে সে সময় দেশে ও বিদেশে বাদ-প্রতিবাদের ঘটা দেখে মনে হয়েছিল, এবার একটা কিছু হবে। তবে হয়নি; বরং প্রতিবছর কার্গো আর ট্যাংকডুবির ঘটনা ঘটতে থাকে। সব খবর ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছায় কি? ঘটনা জঙ্গলে সামলে নিতে পারলে ঢাকার কাছে ঢাকা থাকে, কিন্তু বনবাদাড়ের প্রাণীদের ভোগান্তি চাপা থাকে না।

তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঠিক পরের বছর (২৭ অক্টোবর ২০১৫) ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পশুর নদের চিলা এলাকায় ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জিয়ারাজ। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ শ্যালা নদীর ধানসাগর এলাকায় ১ হাজার ২৫০ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জাবালে নূর। সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি এক হাজার টন কয়লা নিয়ে লাইটার জাহাজ এমভি আইচগাতি ডুবে যায়। ২০১৮ সালে পয়লা বৈশাখের রাতে পশুর নদের হাড়বাড়িয়া এলাকায় ডুবোচরে ধাক্কা লেগে ডুবে যায় লাইটার জাহাজ এমভি বিলাস।

সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পশুর নদের সিগন্যাল টাওয়ার এলাকায় ডুবোচরে আটকে তলা ফেটে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি বিবি। ৭৫০ টন কয়লাবাহী কার্গো জাহাজটি তখন আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

নদীতে জাহাজ ডুবলে সুন্দরবনের কী

আমাদের একজন মন্ত্রী ২০১৪ সালে এ রকম একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। কেউ কেউ জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমলে নেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত যে ডুবে যাওয়া কার্গোতে থাকা কয়লার সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের পানি, জীব ও পরিবেশকে দূষিত করবে। ফলে নদীতে মাছের বংশবিস্তারে সমস্যা হবে। দূষিত পানি ব্যবহার করে স্থানীয় ব্যক্তিদের নানা ধরনের রোগ হতে পারে।

২০১৪ সালে ট্যাংকারডুবির ঘটনার পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি গবেষক দল সুন্দরবনের ১ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা শুরু করে। নিঃসরণের দিন থেকেই গবেষণার কাজ শুরু হয়।

আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের (এপিএইচএ) দেওয়া মানের সঙ্গে সংগতি রেখে গবেষণাটির তত্বীয় মডেল নির্ধারণ করা হয়েছিল। এতে একই সময় যেখানে তেল নিঃসরণ হয়নি এবং যেখানে তেল নিঃসরণ হয়েছে—এমন দুই এলাকার তুলনামূলক অবস্থা দেখার চেষ্টা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, তেল নিঃসরণের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি।

গবেষকেরা লক্ষ করেন, ব্যাঙের রেণু, যা ব্যাঙাচি হিসেবে পরিচিত, এ রকম ছোট ৩৪টি বেনথস (BENTHOS) প্রজাতি সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া যায়। কিন্তু তেল নিঃসরণের পর এ ধরনের মাত্র ৮টি প্রজাতি সেখানে পাওয়া গেছে। বাকি ২৬টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশের সময় গবেষকেরা খুবই স্পষ্ট করে বলেছিলেন, সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে শ্যালা নদীর নৌ রুটটি বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি কোনোভাবেই সুন্দরবনের মধ্যে নদী দিয়ে তেল ও কয়লাবাহী জাহাজ চলতে দেওয়া যাবে না।

গবেষকেরা আরও বলেন, তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকর। যদি কোনো কয়লাবাহী জাহাজ সুন্দরবনের নদীতে ডুবে যায়, তার ক্ষতি কোনোভাবেই বন কাটিয়ে উঠতে পারবে না। বলা বাহুল্য, এ কথা কেউ শোনেনি, বরং ২০১৫ সালের পরে ছোট-বড় সাতটি কয়লাবাহী জলযানের সলিলসমাধি হয়েছে সুন্দরবনে।

ঝড়ে কাহিল সুন্দরবন

কালেভদ্রে নয়, এখন প্রায় প্রতিবছরই ঝড়ের হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে সুন্দরবনকে। এটিই এখন একমাত্র দ্বাররক্ষী কালাপাহাড়। দ্বাররক্ষী দেখতে যতই ষণ্ডা–গুন্ডামার্কা হোক না কেন, মালিককে তাঁর শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখতে হয়। সুন্দরবনের স্বাস্থ্য নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে বৈকি? তাকে পরের ঝড়ের জন্য তৈরি করার দায়িত্ব কি আমরা এড়াতে পারি?

১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৮ সালে বুলবুল, ২০১৯ সালের ফণী এবং ২০২০ সালের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর এ বছর আবার ইয়াসের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে সুন্দরবনকে। একটা ঝড় সামলানোর ঝক্কি কি কম? বারবার ঝড়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে সুন্দরবনের বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আগমনের প্রাক্কালে সমগ্র উপকূলে ৩ নম্বর সংকেত জারি করা হয়। কর্তাদের ধারণা ছিল, তেমন কিছু হবে না। বনকর্মীরা পানির হাল দেখে সেই ধারণায় আস্থা রাখতে পারেননি। কাতর অনুরোধ আর প্রাণহানির শঙ্কায় ঝড়ের আগে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় টহল ফাঁড়ির কর্মীদের। কিন্তু বন্য প্রাণীদের কাতর আওয়াজ আমাদের দিলে পৌঁছায়নি। আমরা জানি, মে নানা বন্য প্রাণীর প্রসবের মাস। হরিণ, বন্য শূকর, গুইসাপসহ বেশ কয়েক প্রজাতির প্রাণী এই মাসে বাচ্চা জন্ম দেয়।

ঝড়ের আগে বন বিভাগের একটি দল সুন্দরবন ঘুরে গিয়েছিল কী পরিমাণ নতুন অতিথি আসছে, তার একটা ধারণা নেওয়ার জন্য। দলটি অবস্থা দেখে খুশি ছিল। আমরা কোনো দিনও জানতে পারব না বানের জলে শূকর ও হরিণশাবকদের কত অংশ ভেসে গেছে। বনকর্তারা খুলেই বলেছেন, জোয়ার-ভাটার টানে অনেক প্রাণী ভেসে সাগরে চলে যেতে পারে। কাজেই সঠিক হিসাব বলা যাবে না। ব্যস, ল্যাটা চুকে গেল।

ইয়াসের প্রভাবে সুন্দরবনের প্রায় পুরো অংশ পরপর দুদিন ডুবে যায় সাঁতারপানিতে। রায়মঙ্গল ও আড়পাঙ্গাশিয়া নদীতে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। সুন্দরবনের সুপেয় পানির প্রধান উৎস ৫৪টি পুকুরের মধ্যে ৫৩টিই লবণপানিতে সয়লাব হয়ে যায়। ফলে বন্য প্রাণী ও বনকর্মীদের সুপেয় পানির সংকট দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

বন বিভাগের সূত্রগুলো জানাচ্ছে, পানির তোড়ে পূর্ব সুন্দরবনের ১৯টি জেটি, ৬টি জলযান (ট্রলার) দুটি গোলঘর, একটি ফুট রেইল, একটি ওয়াচ টাওয়ার, চারটি স্টাফ ব্যারাক ও একটি রেস্টহাউস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত ১০টি অফিসের টিনের চালা উড়ে গেছে ইয়াসের মামুলি বাতাসে। করমজল বন্য প্রাণী অভয়াশ্রমের কুমিরের দুটি শেড নষ্ট হয়েছে। তবে আশার কথা, সব কুমির সেখানে রয়েছে। একটিও ভেসে যায়নি।

উপায় কী হতে পারে

বন বিভাগ তাদের চিরাচরিত পথে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সুন্দরবনে চার রেঞ্জের চার রেঞ্জারকে দিয়ে চারটি কমিটি করে দিয়েছে। আম্পানের পরেও একই কাজ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদন কি দিনের আলোর মুখ দেখেছিল? আর একটি কমিটি কাজ করছিল আগুন নিয়ে, তাদের প্রতিবেদনই–বা কোথায়?

ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পাশাপাশি দায়দায়িত্বের গাফিলতির একটা পরিমাপ হওয়া উচিত। আমাদের আবহাওয়া অফিস যখন বলছে, হাওয়া ছিল না, তখন টিনের ছাউনি উড়ে গেল কীভাবে? প্রাণহানির আশঙ্কায় টহল ফাঁড়ি গুটিয়ে ফেলা হলো, কিন্তু জেটি আর জলযানের দেখভাল কেন করা হলো না—এ প্রশ্ন রেঞ্জারদের কে করবে?

সব কটি প্রতিবেদন নিয়ে বিজ্ঞানী আর সুন্দরবনবাসীদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সুরক্ষা পরিকল্পনা করতে হবে। ধারণানির্ভর নয়, বরং প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। পরিবেশবাদীদের সুরে সুর মিলিয়ে আমরা এখন আর এ কথা বলতে পারব না যে ‘…ভেঙে যাওয়া গাছপালা অপসারণ করা ঠিক হবে না। নিজস্ব প্রাকৃতিক ক্ষমতা বলেই এটি (সুন্দরবনকে) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।’

সুন্দরবনে এমন অনেক গাছপালা আছে, যা বিকশিত হতে মানুষের সহায়তা লাগে। গোলপাতার ঝাড় প্রতিবছর ঝুড়ে (ডাল পালা কেটে পরিষ্কার করা) না দিলে সে বাড়তে পারে না। তাল ও নারকেলের মতো গাছ যেমন ফি বছর পরিষ্কার করতে হয়, তেমনি একই গোত্রভুক্ত গোলপাতাকেও পরিষ্কার করতে হয়। মানুষ ছাড়া সে কাজ সম্ভব নয়। সিডরের পর আবেগসর্বস্ব সিদ্ধান্তে অনেক গোলপাতার ঝাড়ের অকালমৃত্যু দেখতে হয়েছে। আবার মৌয়াল বা মাওয়ালিরা যখন মধু আর মোম সংগ্রহের জন্য গাছে ওঠে, তখন তারা গাছ বেয়ে ওঠা লতা ও পরগাছাগুলো পরিষ্কার করে। এতে গাছের উপকার হয়। নইলে লতায় ছেয়ে গাছের দমবন্ধ অবস্থা হয়।

সামনেই আবার অমাবস্যার কটাল। লোনাপানি আবার হড়হড় করে ঢুকবে বনে। তার আগেই মিষ্টিপানির ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরগুলো সেচে ফেলতে হবে। এরপর বৃষ্টির পানিতে সেগুলো ভরলে কিছুটা সুরাহা হবে।

আম্পান বা তার আগের ঝড় আর জলোচ্ছ্বাস আমাদের পরিষ্কার করেই বলেছিল, ঝোড়ো হাওয়া যেমন মানুষের জন্য বিপদ নয়, তেমনি সুন্দরবনের জন্যও সেটা ভয়ের কিছু নয়। উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মানুষকে বিপদে ফেলে, সুন্দরবনকেও বিপন্ন করে। কাজেই এ ধরনের জোয়ার মোকাবিলায় সুন্দরবনের ভেতরে প্রাণীদের আশ্রয়ের জন্য উঁচু ঢিবি তৈরি করা দরকার, যেটা মুজিব কিল্লা নাম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মানুষের জন্য।

সুন্দরবনের মধ্যে উঁচু পাড় দিয়ে পুকুর খনন করে বন্য প্রাণীর জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পাড়ে যে উঁচু জায়গা থাকবে, সেখানে যাতে বন্য প্রাণী থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের কয়রা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সুন্দরবন অঞ্চল বছরে তিন মিলিমিটার করে দেবে যাচ্ছে। যেকোনো পরিকল্পনায় এ বিষয়টি আমলে নিতে হবে। আগে গঙ্গা নদীর পলি এসে এটা পুরিয়ে দিত। এখন তো তা নাই। তাই এখানকার বাঁধগুলো যথেষ্ট উঁচু ও চওড়া হতে হবে। সবার আগে দেখতে হবে সুশাসন আর জবাবদিহির ঘনত্ব।

l লেখক: গবেষক [email protected]