হালদায় হুমকিতে মা মাছ ও ডলফিন

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মরে ভেসে ওঠা একটি ডলফিনকে উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতে ডাঙায় তুলেন স্থানীয় লোকজন। ২৪ মে দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মরে ভেসে ওঠা একটি ডলফিনকে উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতে ডাঙায় তুলেন স্থানীয় লোকজন। ২৪ মে দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের মইশকরম এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

গত ২ মাসেই মরে ভেসে উঠেছে ৩টি ডলফিন ও ২টি মা মাছ। আড়াই বছরে এই নদীতে মারা গেছে ২৫টি ডলফিন।

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে বিচরণ আছে অতি বিপন্ন জলজ প্রাণী গাঙ্গেয় ডলফিনের। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় কার্পজাতীয় মা মাছ এ নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। কিন্তু নদীর মূল সম্পদ মা মাছ ও ডলফিনের আবাসস্থল এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে। নদীতে একের পর এক মরে ভেসে উঠছে ডলফিন ও মা মাছ।

এসব জলজ প্রাণী রক্ষায় সরকার ২০০৭ সালে নদীর কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ফটিকছড়ি নাজিরহাট পর্যন্ত এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে সরকার নদীর সব স্থানে বালুর ইজারা মহাল তুলে নিয়ে বালু উত্তোলন, বালুবাহী ড্রেজার, যান্ত্রিক নৌ চলাচল ও জাল পাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব নিষেধাজ্ঞা ঠিকমতো কার্যকর হয় না। ফলে আঘাতজনিত কারণে ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক। গত ২ মাসেই মরে ভেসে উঠেছে ৩টি ডলফিন ও ২টি মা মাছ। আড়াই বছরে এই নদীতে মারা গেছে ২৫টি ডলফিন।

স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা বলছেন, মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমেও নদীতে বালুবাহী ড্রেজার ও যান্ত্রিক নৌকা চলাচল করছে। মা মাছ আর ডলফিন তো মরবেই।

মা মাছ ও ডলফিন রক্ষায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরীয়া। তাঁর কথা, প্রশাসন সক্রিয় হলে এই নদীতে বালুবাহী ড্রেজার চলতে পারত না। সংলগ্ন কলকারখানাও দূষণ ঘটাতে পারত না। এখনো অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও এলাকার কারখানা ও আবাসিক বর্জ্য খন্দকিয়া খাল দিয়ে নদীতে পড়ছে। ফটিকছড়ি রাবার ড্যাম ও খাগড়াছড়ির মানিকছড়ির তামাক চাষও হালদার জন্য ক্ষতিকর।

সরেজমিন

হালদা নদীর বিভিন্ন অংশে সম্প্রতি সরেজমিনে দেখে গেছে, অবাধে চলছে যান্ত্রিক নৌযানের চলাচল ও জাল দিয়ে মাছ শিকারের দৃশ্য।

নদীপারের বাসিন্দা ও রাউজান পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলমগীর আলী প্রথম আলোকে বলেন, মা মাছ ও ডলফিন রক্ষা করতে হলে যান্ত্রিক নৌযান বন্ধ করতে হবে। কারণ, নৌযানের পাখার আঘাতে মা মাছ ও ডলফিন দুটিই মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, নদীতে বিষপ্রয়োগেও মাছ ধরার ঘটনা ঘটে প্রায় সময়।

প্রায় ৪৫ বছর ধরে হালদা নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করেন হাটহাজারীর মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন। তাঁর কথা, মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই। তারপরও আইন প্রয়োগ করা হয় কেবল জেলেদের ওপর। যতসংখ্যক জাল জব্দ করা হয়, সেই তুলনায় বালুবাহী ড্রেজার ও নৌযান জব্দের ঘটনা কম।

আইনি পদক্ষেপ

ডলফিন হত্যার ঘটনায় ১০ মে প্রথম মামলা হয়। বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম রেঞ্জ কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন তালুকদার বন বিভাগে মামলাটি করেন। তিনি নিজে এ বিষয়ে কাজ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর রয়েছে। ২৪ মে আরেকটি ডলফিন উদ্ধার হওয়ার ঘটনায়ও জিডি করেছেন বলে জানান তিনি।

১২ মে ডলফিন রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ই-মেইল যোগে আদালতকে জানাতে বলা হয়েছিল সংশ্লিষ্টদের। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এরপর ১৯ মে শুনানি শেষে হালদা রক্ষায় একটি কমিটি করে দেন হাইকোর্ট।

প্রশাসনের ভাষ্য

প্রশাসন বলছে, তাদের পদক্ষেপের কারণে এবার ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহ করা গেছে, যা ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রাউজান ইউএনও জোনায়েদ কবির ও হাটহাজারী ইউএনও রুহুল আমিন বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।