৩১ দিনে ৩৭৩২ কিমি পাড়ি

গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসানোর সময় ব্যাটমুনখ দাভারাসেনের কোলে পাখিটি। গত ২০ আগস্ট মঙ্গোলিয়ার বুনটসাগান হ্রদে
ছবি: সংগৃহীত

দ‌ক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমির একটি হ্রদের নাম বুনটসাগান। বায়নখংগুর প্রদেশের বিশাল ওই জলাধারটি পরিযায়ী পাখিদের বড় আবাস। গ্রীষ্মে ওই হ্রদে পালাসি কুড়া ইগল খাবার ধরে খায়। শীত নামার আগেই ইগলগুলো পাড়ি জমায় বাংলাদেশের হাওর এলাকায়। পালাসি কুড়া ইগলের এই যাত্রার কথা এত দিন আমরা অনুমান করতাম। কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই পাখিটির পরিযায়নপথ আবিষ্কৃত
হলো। কীভাবে তা সম্ভব হলো, সেই গল্পটাই আজ বলব।

একটি মেয়ে কুড়া ইগলের গায়ে গত ২০ আগস্ট স্যাটেলাইট যন্ত্র বসানো হলো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কুড়া ইগলের পরিযায়ন–রহস্য বের করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ায় আমার পাখি গবেষক বন্ধু ব্যাটমুনখ দাভারাসেন এই অসাধারণ কাজটি করেছেন। এর আগে এ বছরের মার্চ মাসে টাংগুয়ার হাওরে পালাসি কুড়া ইগলের গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসানোর কথা ছিল। করানোকালে আমাদের আরেক গবেষক লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস বাংলাদেশে আসতে না পারায় তা আর হলো না।

ব্যাটমুনখ কুড়া ইগলটির নাম দেন আরাঙ্গা। পাখিটির ভ্রমণপথ দেখে ও গল্প শুনে পাখি গবেষকেরা অবাক হয়ে গেছেন। আরাঙ্গার পরিযায়ন গল্প মাত্র ৩১ দিনের। এ সময়ের মধ্যে সে বুনটসাগান লেক থেকে টাংগুয়ার হাওরে পৌঁছে গেছে। গুগল ম্যাপের হিসাব বলছে, পাখিটি ৩ হাজার ৭৩২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে।

আরাঙ্গার গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্রটি বসানোর সাত দিনের মাথায় সে মঙ্গোলিয়া থেকে চীনের সীমানায় ঢুকে। এরপর পাখিটি প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে চীন-ভুটানের সীমান্তরেখায় প্রবেশ করে ১৩ সেপ্টেম্বর। চীনের সীমানায় পাখিটি ১৩ দিন ছিল। এ সময় পাখিটি প্রায় ৮-১০টি মিঠাপানির লেকে বিশ্রাম নেয় এবং খাবার সংগ্রহ করে।

৩১ দিন উড়ে কুড়া ইগলটি মঙ্গোলিয়া থেকে গত শনিবার বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌঁছায়।

ছোট–বড় বিভিন্ন পর্বতমালা অতিক্রম করেছে আরাঙ্গা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪২১ মিটার ওপর দিয়ে সে উড়েছে এবং পুরো যাত্রাকালে তার ওড়ার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১২২ কিলোমিটার। মজার ব্যাপার হলো পাখিটি একটানা প্রায় ১০ ঘণ্টা উড়েছে এবং সে সময় ৩৪১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। মঙ্গোলিয়া থেকে দীর্ঘ এই ভ্রমণযাত্রায় আরাঙ্গা ৩৮টি জায়গায় থেমে বিশ্রাম নিয়েছে।

১৯ সেপ্টেম্বর আরাঙ্গা টাংগুয়ার হাওরে পৌঁছায়। পাখিটি এখন সেখানেই আছে। আর একটু পানি কমলেই হাওর থেকে মাছ ধরে খাবে। নিরাপদ একটি জায়গায় বাসা বানিয়ে সংসার শুরু করবে। বাচ্চা বড় হলে আবার ফিরে যাবে তিব্বত আর মঙ্গোলিয়ার কোনো হ্রদে।

পালাসি কুড়া ইগল জাতের পাখির প্রধান খাবার মাছ আর বুনো পাখি। বাংলাদেশের হাওর এলাকায় এই দুটিই পর্যাপ্ত পাওয়া যায়। তিব্বত আর মঙ্গোলিয়ার হ্রদগুলোতেও মাছ আর বুনো পাখি আছে। তবে ওই অঞ্চলে কোনো বড় গাছ নেই। শীতকালে প্রায় সব অঞ্চল বরফে ঢেকে যায়। তাই এ সময় তারা পাড়ি জমায় বাংলাদেশ ও ভারতের মিঠাপানির জলাশয়গুলোতে। খাবার আর বাসা বানানোর জায়গা থাকায় বাংলাদেশের হাওর তাদের সবচেয়ে প্রিয়। পালাসি কুড়া ইগলকে বলা হয় হাওরের রাজা। পুরো হাওর সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে পাখিটি।

গত দুই বছরে আমরা প্রায় ৩৫টি গিরিয়া হাঁসে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়েছি। গবেষণায় দেখতে পাচ্ছি, প্রতিটি পাখির যাত্রা চীন-তিব্বত আর মঙ্গোলিয়ার হ্রদগুলোতে। পাখির পরিযায়ন নিয়ে এই গবেষণাকাজটি করছে সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয় আর আইইউসিএন বাংলাদেশের যৌথ গবেষক দল। পালাসি কুড়া ইগলের এই গবেষণাকাজে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মঙ্গোলিয়ার ওয়াইল্ডলাইফ সায়েন্স অ্যান্ড কনজারভেশন সেন্টারের একটি গবেষক দল।

আশা করছি, শীতকালজুড়ে আমরা আরাঙ্গার গতিবিধ পর্যবেক্ষণ করতে পারব। শীতের প্রথম ভাগে এ বছর আমরা টাংগুয়ার হাওরে আরও কয়েকটি কুড়া ইগলের গায়ে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে অনুসন্ধান চালাব।