৩৫ বছর ধরে চাষ হচ্ছে অপ্রচলিত ‘গোটা ইরি’

জাতটি জোয়ারের লবণপানিসহ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকে। বৃষ্টি হলেও পাকা ধানের গাছ নুয়ে পড়ে না। ফলনও ভালো।

ধান
ফাইল ছবি

বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে আউশ মৌসুমে স্থানীয় একটি জাতের ধানের আবাদ হচ্ছে। এটি ‘গোটা ইরি’ নামে পরিচিত। তবে এখনো পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে সংরক্ষণ ও গবেষণা না হওয়ায় ক্রমেই এটির আবাদ কমে যাচ্ছে।

কৃষকেরা বলছেন, ধানের এই জাতটি জোয়ারের লবণপানিসহ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকে। বৃষ্টি হলেও পাকা ধানের গাছ নুয়ে পড়ে না। এটির উৎপাদন ব্যয় কম। ফলনও বেশ ভালো।

কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, মূলত কৃষকেরাই জাতটি উদ্ভাবন ও টিকিয়ে রেখেছেন। জাতটি সংরক্ষণ ও উন্নত করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া গেলে কৃষিক্ষেত্রে বড় সুফল আসতে পারে।

সম্প্রতি আমতলীর চলাভাঙা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক মিলন মৃধা গোটা ইরি খেতের পরিচর্যা করছেন। মিলন বলেন, তিনি দেড় একর জমিতে গোটা ইরি আবাদ করেছেন। অপেক্ষাকৃত খাটো গোছের এই ধানের চাল কিছুটা মোটা হওয়ায় এলাকায় চাহিদা বেশি। খেতেও সুস্বাদু। পোকার আক্রমণও কম। দামও অন্য ধানের চেয়ে বেশি। ঝড়-বৃষ্টিতে এই ধান নুয়ে পড়ে না। বাবার আমল থেকে এই ধান আবাদ হচ্ছে। তবে কীভাবে এই জাত এসেছে, তিনি জানেন না।

তালতলীর গাবতলা গ্রামের কার্তিক চন্দ্র শীল এবার দুই একরে গোটা ইরির আবাদ করেছেন। তিনি বললেন, ‘২৫ বছর আগে আমাদের এলাকার একজন কৃষক প্রথম এই ধানের আবাদ করেন। ফলন ভালো হওয়ায় পরের বছর তাঁর কাছ থেকে বীজ নিয়ে আমিও আবাদ করি। এরপর একে একে গ্রামে এই ধানের আবাদ ছড়িয়ে যায়।’

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এই ধানের সবচেয়ে বড় গুণ হলো পাকলে তিন-চার দিন বৃষ্টি হলেও ধানের গাছ নুয়ে পড়ে না। আবার খেতে পাকা ধান থাকা অবস্থায় কয়েক দিন বৃষ্টি হলে অন্যান্য জাতের ধানে অঙ্কুরোদগম হলেও এই ধানে তা হয় না। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। অন্য জাতের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শক্তপোক্ত এই ধানের গাছ জোয়ারের পানিতেও টিকে থাকতে সক্ষম।

এই জাতটি যাতে বিলুপ্ত না হয়, সে জন্য আমরা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি।
মো. আলমগীর হোসেন বলেন, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ব্রির বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়

আমতলী ও তালতলী উপজেলার কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও কৃষকেরা বলছেন, আগে আউশ মৌসুমে পুরোটাই গোটা ইরি ধানের আবাদ হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এর আবাদ কমছে। ব্রি-৪৮ এই স্থান দখল করে নিচ্ছে। এবার তা আরও কমেছে। সরকার আউশের উৎপাদন বাড়াতে এবার কৃষকদের ব্রি-৪৮ বীজ সহায়তা দেওয়ায় স্থানীয় জাতের এই ধানের আবাদ আরও কমেছে।

কয়েকজন কৃষক বলেন, জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণ করে দেওয়ার পর ঝড়, জলোচ্ছ্বাসেও কৃষকদের এই ধান নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় না। ধানটি বৈরী পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে সক্ষম। ধানটির উৎপাদন হেক্টরপ্রতি চার থেকে পাঁচ মেট্রিক টন। ব্রি-৪৮–এর উৎপাদনও একই রকম।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ বছর আমতলীতে আউশ আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর। এর মধ্যে আড়াই হাজার হেক্টর ‘গোটা ইরি’। তালতলীতে এবার আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে গোটা ইরি মাত্র ৫০ হেক্টর।

কৃষকেরা বলছেন, সংরক্ষণ ও গবেষণা না হলে স্থানীয় এ জাতটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আমতলী কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘সম্ভবত জাতটি ১৯৮০ সালে ফিলিপাইন থেকে এ দেশে এসেছিল। সেটা ছিল এইচ আর-৮ জাতের ধান। স্থানীয় কৃষকেরা সেই জাতটিকে টিকিয়ে রেখেছেন বলে আমার ধারণা। তবে এই জাতের ব্যাপারে আমাদের কোনো পর্যবেক্ষণ নেই, গবেষণাও নেই।’

তবে ব্রির বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এইচআর-৮ ধানটি উদ্ভাবন হয় ১৯৬৬ সালে। সেটি ১৯৭০-এর দশকে বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আকতার হামিদ এ দেশে আনেন। সেটি ছিল বোরো মৌসুমের ধান। ‘গোটা ইরি’ এইচ আর-৮ ধানের বংশ নয়। এটা ওই এলাকার কৃষকেরাই উদ্ভাবন ও সংরক্ষণ করে চলেছেন বলে তিনি মনে করেন।

ব্রির বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এই জাতটি যাতে বিলুপ্ত না হয়, সে জন্য আমরা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছি। একই সঙ্গে এর উন্নতকরণের জন্য কাজ করব। তবে জাতটি সবদিক থেকে ভালো গুণাগুণ থাকলেও আমাদের অন্য প্রজাতির আউশ ধানের জীবনকাল যেখানে ১১০ থেকে ১১৫ দিন, সেখানে এ প্রজাতিটির জীবনকাল ১৩০ থেকে ১৩৫ দিন।’