মাদারীপুরে সেই দুর্ঘটনা বাসের টায়ার ফেটেই

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুরে এক্সপ্রেসওয়েতে গত ১৯ মার্চ দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যায় যাত্রীবাহী বাসটি
ছবি : প্রথম আলো

মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যাত্রীবাহী বাসটির টায়ার ফেটে। ওই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য অন্য কারণগুলোর চেয়ে এটাই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)।

গত ১৯ মার্চের সেই দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হন, আহত হন ২৬ জন। এআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে দ্রুতগতির মহাসড়কের (এক্সপ্রেসওয়ে) ওই অংশে নিরাপত্তাবেষ্টনী বা গার্ড রেল না থাকার কারণে।

ওই দুর্ঘটনার পর এআরআইয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল সরেজমিন তদন্ত করে। রোববার বুয়েট কাউন্সিল ভবনে সেই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক।

এআরআইয়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বাসের ব্রেকের ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেনি। চালক যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগও পেয়েছিলেন। তাই চালকের ক্লান্তি এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনায় নেয়নি এআরআই। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক বিশ্বমানের। এই মহাসড়কে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচলের অনুমতি আছে। তদন্তে এআরআই দেখেছে, দুর্ঘটনার শিকার ইমাদ পরিবহনের বাসটি সে সময় ৭৯ কিলোমিটার গতিতে চলছিল। চালক মধ্যম শ্রেণির লাইসেন্স নিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন।

তবে তিনি ভারী যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিলেন। দুর্ঘটনার আগে চালক পথচারীকে আঘাত করেছিলেন, এমন কোনো প্রমাণও নেই। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্যও দুর্ঘটনাটি ঘটেনি। দুর্ঘটনাটি আকস্মিকভাবে হয়েছিল, যা টায়ার ফেটে যাওয়ার কারণে হতে পারে। তাই টায়ার ফেটে যাওয়াই এই দুর্ঘটনার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ।

একটা এক্সপ্রেসওয়ে যেভাবে হওয়া দরকার ছিল, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এটা সেভাবে হয়নি। এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে
অধ্যাপক সামছুল হক, পরিচালক এআরআই, বুয়েট

যানবাহনের তথ্যের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইমাদ পরিবহনের বাসটি ২০১৭ সালে আমদানি করা ও অশোক লিল্যান্ড কোম্পানির তৈরি। ২০১৮ সালে নিবন্ধন নেওয়া হয়। ২০২২ সালের শেষ দিকে আরেকটি দুর্ঘটনায় পড়ার কারণে এই বাসের চলাচলের অনুমতি বাতিল করা হয়েছিল। চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেসের মেয়াদও শেষ হয়। তবে বাসের অভ্যন্তরীণ ও বহির্ভাগ ভালো ছিল। বাসটিতে চালক ও গতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল। তবে বাসের টায়ার অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও মানসম্পন্ন ছিল না। সামনের বাঁ পাশের টায়ার ছিল ফাটা।

কেন এত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে এআরআইয়ের এই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, একটি কালভার্টের ঠিক আগে বাসটির পথচ্যুতি ঘটে। শেষ পর্যন্ত বাসটি কালভার্টের কংক্রিটের দেয়ালে ওপরের অংশে ধাক্কা খায়। ফলে বাসের সামনের অংশ ভেঙে যায় এবং ভেতরের দিকে চেপে যায়। যেহেতু বাসটি ভেতরের দিকে চেপে গিয়েছিল, তাই চালক, সুপারভাইজার, চালকের সহকারী এবং সামনের সিটের যাত্রীদের সামনে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা না থাকায় ১৪ জনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে এবং অনেকে গুরুতর আহত হন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক থেকে কোনো গাড়ি যেন ছিটকে না পড়ে এবং কোনো বিপজ্জনক বস্তু বা কাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা না খায়, সে জন্য দ্রুতগতির সড়কের পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা জরুরি। কিন্তু মহাসড়কের ওই অংশে সেই বেষ্টনী ছিল না। বেষ্টনী থাকলে বাসটি সড়ক থেকে এত দূরে ছিটকে পড়ত না। কালভার্টের সঙ্গে ধাক্কাও এড়ানো যেত। সে ক্ষেত্রে এত প্রাণহানি না-ও হতে পারত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য দুর্ঘটনার স্থান পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে এআরআইয়ের কারিগরি দল। সেই দলের সদস্যরা দুর্ঘটনাকবলিত বাসের সর্বশেষ অবস্থান চিহ্নিত করেন। সড়কে টায়ারের দাগ পর্যবেক্ষণ করেন। বাসচালকের ডিউটি রোস্টার (বাস চালানোর পালা) দেখেন। দুর্ঘটনার শিকার বাসের ক্ষতির ধরনও পরীক্ষা করেন তাঁরা। বাসে যাত্রীদের বসার অবস্থানও পর্যবেক্ষণ করেন। হতাহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য, টায়ার বিশেষজ্ঞ ও জিপিএস ট্র্যাকিং পরিষেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকার নেন।

প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘ওই মহাসড়ক সবচেয়ে উন্নত মানের। তাতে স্থানীয় যানবাহন চলাচলের আলাদা পথ (সার্ভিস রোড) আছে। কোনো মোড় নেই। সড়ক পারাপার হওয়ার জন্য ইন্টারসেকশন-ইন্টারচেঞ্জ আছে। এ রকম রাস্তা বাংলাদেশে প্রথম হয়েছে। কিন্তু একটা এক্সপ্রেসওয়ে যেভাবে হওয়া দরকার ছিল, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এটা সেভাবে হয়নি। এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে।’

সুপারিশ

দুর্ঘটনা রোধে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ভারী বাণিজ্যিক যানবাহনে অবশ্যই ট্র্যাকিং যন্ত্র থাকতে হবে। সেই যন্ত্রের সঙ্গে চালকের রোস্টার ও ড্রাইভিং রেজিস্টার আপলোড করতে হবে, যেন চালক বেশি সময় গাড়ি চালাচ্ছেন কি না, তা সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়।

এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে আগে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাক্‌-নিরাপত্তা নিরীক্ষা করার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। আমদানি করা টায়ারের উপাদানের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইকে ধ্বংসাত্মক ও অধ্বংসাত্মক, উভয় ধরনের পরীক্ষা করার সুবিধা দিতে হবে। বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।