ধর্ষণের শিকার মেয়েটি চিকিৎসা শেষে আজ বাড়ি ফিরছেন

ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালছবি: প্রথম আলো

ধর্ষণের শিকার মেয়েটির শরীর ও মনের ওপর দিয়ে ঝড় বইছে। তিনি এক সপ্তাহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন। পরে হাসপাতালটির ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) এখন তিনি নিজে নিজে হাঁটতে পারেন। আজ সোমবার ওসিসি থেকে তিনি ছুটি পেয়েছেন। পুলিশের সহায়তায় পরিবারের সঙ্গে তাঁর বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি চলছে।

৮ মে প্রথম আলোয় ‘মেয়ে শুধু বলে, বাবা ভয় লাগতেছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় নিজেদের ভাড়া বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে সেদিনই দিবাগত রাত একটার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ধর্ষণে মেয়েটির জননাঙ্গ ছিঁড়ে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রোপচারের পর রক্তচাপ কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। এ কারণে তাঁকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়। মেয়েটির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে আইসিইউতে থাকা অবস্থায় তাঁর ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ বা মৃত্যু-পূর্ব জবানবন্দি নিয়ে রেখেছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট।

আজ সকালে ওসিসির সামনে মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা হয়। মেয়ে বাঁচবে কি না, তা একসময় বুঝতে পারছিলেন না তিনি। এখন মেয়ে বাড়ি ফিরছে, তাই নানা ভোগান্তির মধ্যেও তিনি কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন। তবে জানান, মেয়ে এখনো অনেক দুর্বল। ওসিসির চিকিৎসকেরা বাড়ি নিয়ে মেয়েকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতে বলে দিয়েছেন।

বছর দুয়েক আগে অভাব-অনটনের কারণে মেয়েটির পরিবার রাজশাহী থেকে আশুলিয়ায় আসে। তখন থেকেই মেয়েটি পোশাক কারখানায় কাজ করে আসছিলেন। মেয়েটির বাবা দিনমজুর। মা স্থানীয় একটি হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। পরিবারটি চলছিল এই তিনজনের আয়ে। তবে ২৪ এপ্রিল থেকে তিনজনেরই কাজ বন্ধ।

বাবা জানান, হাসপাতালের বারান্দায় থাকতে থাকতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তাঁরা আবার কবে কাজে ফিরতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। সব মিলে অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে তাঁদের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষ করে ওসিসি থেকে যে সেবা মেয়েকে দেওয়া হয়েছে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই বাবা।

প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকেই এই বাবাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন। প্রথম আলো ও আর্থিক সহায়তাকারী ব্যক্তিদের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।

মেয়েটির বাবা কাজ করলে কোনো দিন ৫০০ টাকা, আবার কোনো দিন ৬০০ টাকা মজুরি পান। মেয়েটির মা পান আট হাজার টাকা। আর মেয়েটি আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা পান। অতিরিক্ত সময় (ওভারটাইম) কাজ করলে তিনি আরও কিছু বেশি টাকা পান। ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি মেয়েটির সঙ্গে একই পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এখন কারাগারে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের (চতুর্থ পর্ব) অধীন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সমন্বিত সেবা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও আইনি সেবা দিচ্ছে।

ওসিসির সমন্বয়কারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটি হাসপাতালে আর থাকতে চাচ্ছিলেন না। এ ছাড়া তাঁর শারীরিক অবস্থাও এখন ভালো। তাই তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। ছুটি দেওয়ার আগে কাউন্সেলিং করা হয়েছে। বাড়ি ফিরলেও তিনি ওসিসিতে এসে বিনা মূল্যে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা সহায়তা নিতে পারবেন। আর ওসিসির আইনজীবী তাঁর মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। মেয়েটির পরিবারকে চিকিৎসার পেছনে কোনো খরচ গুনতে হয়নি। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালকের নির্দেশনা ছিল।

মেয়েটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ধর্ষণের পর মেয়েটি শকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়েছিল, যা সাধারণত ধর্ষণের ঘটনায় খুব একটা ঘটে না। ধর্ষণে তাঁর জননাঙ্গ ছিঁড়ে গিয়েছিল। ছয় ব্যাগ রক্ত দিতে হয় তাঁকে। সব মিলিয়ে তিনি ট্রমার মধ্যে আছেন। ওসিসিতে তাঁকে দিনে ছয়টি ডিমসহ উন্নতমানের খাবার দেওয়া হয়। বাড়িতে ফেরার পরও কিছুদিন তাঁকে ভালো খাবার দিতে হবে, তাঁর শারীরিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য।

আরও পড়ুন

নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য ওসিসি থেকে যে পুনর্বাসন সেবা দেওয়া হতো, বর্তমানে তা বন্ধ আছে বলে জানান সাবিনা ইয়াসমিন।

ধর্ষণের অভিযোগে ২৪ এপ্রিল রাতেই মেয়েটির বাবা আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। তিনি জানিয়েছিলেন, মামলা করার পর আসামির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জন ফোন করেন। তাঁরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দেন। তাঁর বাবা আজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কোনোভাবেই আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করবেন না। তিনি আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।

মামলাটি তদন্ত করছেন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নূর মোহাম্মদ খান। ৮ মে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ২৫ এপ্রিল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠান আদালত। আসামি ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। প্রাথমিক তদন্তেও ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।

ওসিসির আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার মেয়েটির মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসামি এখন কারাগারে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দ্রুত অভিযোগপত্র দিলে, বিচারে আসামি দ্রুত শাস্তি পেলে, একটা দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। মেয়েটির পুনর্বাসনে অন্যদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।