কে কাকে অবৈধ বলবে

দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ সরু হয়ে গেছে দখলে। বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এর শরীরজুড়ে। গতকাল শহরের পুলিশ সুপারের কার্যালয় এলাকায়
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা

পাঁচ বছর আগেও পরিবেশবিদেরা যখন শঙ্কার কথা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন, তখনই কাপ্তাই হ্রদের হাঁসফাঁস অবস্থা। হ্রদের বুকে গড়ে উঠছে একের পর এক বিষফোড়ার দালান। জাতীয় নদী কমিশন ২০১৯ সালে ২৬ জন দখলদারের তালিকাও করে। কিন্তু উচ্ছেদ আর হয়নি। বরং দিন দিন যুক্ত হলো ‘ওজনদার’ দখলদারেরা। নাম শুনলে চমকে ওঠার মতোই—খোদ পৌর মেয়র, জেলা পরিষদ, জেলা পুলিশ, আওয়ামী লীগ। তাঁদের দেখাদেখি বসে নেই সাধারণেরাও। হোটেল মালিক, দোকানি, স্থানীয় লোকজন—যে যেভাবে পেরেছে দখলে নিয়েছে। শহরের ‘হৃৎপিণ্ড’ ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে যেন বাকি থাকল না কিছুই।

এখন প্রশ্ন হলো হ্রদ রক্ষা করবে কে? বহু পুরোনো ও চর্চিত সেই বাক্যটি একেবারে জুতসই রাঙামাটির ক্ষেত্রে—‘রক্ষক যখন ভক্ষক’। যেখানে পৌরসভা জলাধার বা হ্রদের দখল ঠেকানো, দূষণ রোধ ও অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসনকে সহায়তা করবে উচ্ছেদে, সেখানে পৌর মেয়র নিজেই হ্রদের ‘বুকে ছুরি’ চালিয়ে দিয়েছেন। বহুতল ভবন গড়ে তুলছেন হ্রদ দখল করে। তাঁর দাবি, ভবনটির অর্ধেক পানিতে থাকলেও তেমন ক্ষতি হবে না! অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে পৌরসভার প্রধান পরিকল্পনাবিদ সুবর্ণ চাকমার অসহায়ত্ব বলে দেয় সেখানকার পরিস্থিতি। কাকে উচ্ছেদ করবেন? কাকে বলবেন দখলদার। তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই উত্তম। কারণ ‘বোবার কোনো শত্রু নেই’।

পৌরসভা থেকে আরও একটু ওপরের দিকে গেলে জেলা পরিষদ। পৌরসভায় কর্মকাণ্ড দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের। সোজা বাংলায় বললে, পৌরসভা ভুল করলে তারা শুধরে দেবে। নিয়ে আসবে ঠিক ‘ট্র্যাকে’। কিন্তু জেলা পরিষদ নিজেই লাইনচ্যুত। হ্রদ দখল করে তারা বানাচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার। ফলে বাকিরা পিছিয়ে থাকবে কেন? রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদা বেগমের বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট, ‘পুলিশ মেস যদি হ্রদ দখল করে হয়, তাহলে পৌরসভা ভবনও হ্রদের ওপর। কারণ, দুটি একই লাইনে।’

সাধারণ দখলদারদের কথা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়, ‘তাহলে আমাদের আর দোষ কী’। বিষয়টি এমন, মিথ্যার চর্চা হতে হতে একসময় সত্য চাপা পড়ে মিথ্যাটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। রাঙামাটির ক্ষেত্রেও তা–ই। এখন আর অবৈধ দখলদার বলার জো নেই। কে কাকে অবৈধ বলবে!

রাঙামাটির পর্যটনশিল্পের বড় ধরনের বিকাশ হয়েছে এই হ্রদ ঘিরে। বছরে দেড় থেকে দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন কাপ্তাই হ্রদে। পর্যটকেরা হ্রদ-পাহাড়ের টানে ছুটে আসেন রাঙামাটি। হ্রদের এমন করুণ হাল দেখে কী নিয়ে ফিরে যাবেন পর্যটকেরা! পর্যটনের পাশাপাশি মৎস্য খাতে এই হ্রদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ ছাড়া রাঙামাটি শহরের সঙ্গে জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ৬টির যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই হ্রদ। রাঙামাটি লঞ্চ মালিক সমিতির হিসাবে, অন্তত এক লাখ মানুষ কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। অথচ সেই হ্রদ ‘হত্যায়’ সবাই মেতে উঠেছে।

হ্রদ দখলের প্রভাবও ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। কাপ্তাই হ্রদের জীববৈচিত্র্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে গবেষণা করছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগ। গবেষণায় উঠে এসেছে, হ্রদের যেখানে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে, সেখানে মাছ পাওয়া যায় কম। সেখানে দূষণও বেশি। পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) জরিপও বলছে, হ্রদে অহরহ মিলত এমন প্রজাতির মাছ কমে গেছে। রুই, কাতলা, মৃগেল, বাচা, পাবদা ও চিতল মাছ একেবারে কমে গেছে। ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে দেশি সরপুঁটি, ঘাউরা, বাগাড়, দেশি পাঙাশ, সিলন, দেশি মহাশোল, ফাঁইস্যা, সাদা ঘনিয়া, মোহিনী বাটাসহ বেশ কিছু প্রজাতি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কাপ্তাই হ্রদের দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হ্রদের ধারে মানুষের বসতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মানবসৃষ্ট কারণে হ্রদের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারি সংস্থাগুলো যদি বিদ্যমান আইনের আওতায় সঠিক ভূমিকা পালন করে, তাহলে কাপ্তাই হ্রদ অনেকাংশে রক্ষা পাবে।

কিন্তু রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, নতুন করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাগুলোর বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। তবে তিনি বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ হলে তিনি কি আর সেদিকে এগোতে পারবেন?

জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়া হলে কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি হয়। ১৯৫৬ সালে শুরু হয়ে ১৯৬২ সালে শেষ হয় বাঁধের নির্মাণকাজ। বাঁধের কারণে ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি ডুবে যায়, যা ওই এলাকার মোট কৃষিজমির ৪০ শতাংশ। রাঙামাটির বরকল উপজেলার বড় হরিণা এলাকা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রান্তে হ্রদের সীমানা। এরপর ভারতের মিজোরামেও এর বিস্তৃতি আছে। মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে কর্ণফুলীর উৎপত্তি। রাঙামাটির আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ির মহালছড়ি এলাকাজুড়ে হ্রদটির অবস্থান। বর্তমানে হ্রদের আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। কাপ্তাই হ্রদ বড় আশীর্বাদ এখানকার মানুষের জন্য। পাহাড়, নদী, হ্রদ ঘিরে গড়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, লোকগাথা, সাহিত্য। পাহাড়ের মানুষের জীবনধারাও প্রবর্তিত প্রকৃতিকে ঘিরে, যা অন্য অঞ্চল থেকে আলাদা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে। সেই স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নষ্ট হওয়ার পথে। পাহাড় কাটাও চলছে সামনে। প্রকৃতির ওপর অত্যাচার হলে প্রতিশোধ সে নেবেই। তার বড় নজির ২০১৭ সালের ১৩ জুনের ভয়াবহ পাহাড়ধস। সেদিন প্রবল বর্ষণের ফলে রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ১২০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেদিনের স্বজনহারাদের আর্তনাদ এখনো রাঙামাটির বাতাসে।

তবে কি আরেকটি পরিণতির অপেক্ষায় রাঙামাটি। তবু যেন কারও হুঁশ নেই। কী নির্লিপ্ততায় টুঁটি চেপে ধরে শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষায় সবাই। স্থানীয় নাগরিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় নানা ইস্যুতে মাঠে নামলেও হ্রদ দখল নিয়ে তারাও চুপ। তবে সময় শেষ হয়ে যায়নি। কাপ্তাই হ্রদ রক্ষার এই দায়িত্ব নিতে হবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। পরিবেশ–বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনের সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া হ্রদ বাঁচানো সম্ভব নয়।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো

আরও পড়ুন