কাবিননামায় ‘কুমারী’ শব্দ এখনো লিখতে হচ্ছে নাজিয়াদের

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, কাবিননামায় ‘কুমারী’ শব্দ থাকা নারীর জন্য অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সংবিধান ও সিডও সনদের পরিপন্থীফাইল ছবি: প্রথম আলো

১৯৪৩ সালের ২ মার্চ আক্রামুজ্জামান মিয়া ও লায়লা বেগমের বিয়ে হয়েছিল। এই বিয়ের কাবিননামা সম্প্রতি খুঁজে পান স্বজনেরা।

আট দশকের বেশি সময় আগের কাবিননামাটি দেখে স্বজনেরা উৎফুল্ল হন। এ নিয়ে গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্মৃতির স্মারক: ১৯৪৩ সালের এই কাবিননামায় কী আছে’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। দাদু-দিদার কাবিননামা নিয়ে লেখাটি লিখেন এলিজা বিনতে এলাহী। ব্রিটিশ সরকারের সিলমোহর দেওয়া বাংলা ও উর্দুতে হাতে লেখা কাবিননামাটি সময়ের বিবর্তনে অনেক জায়গায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কাবিননামাটিতে বরকে ‘দুলহা’ ও কনেকে ‘দুলহান’ বলা হয়েছে। কাবিননামায় লায়লার ক্ষেত্রে ‘কুমারী’ লেখা আছে। তবে আক্রামুজ্জামানের ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত কিছু লেখা নেই।

আরও পড়ুন

রাজধানীর একটি আউটসোর্সিং কোম্পানিতে চাকরি করেন নাজিয়া খান ইউসুফজাই। গত ২০ জানুয়ারি তিনি বিয়ে করেন একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহসিনুর রহমানকে। নাজিয়া ‘কুমারী’ কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর তাঁকে কাবিননামায় লিখতে হয়েছে। তবে মহসিনুর ‘কুমার’ কি না, তা কোথাও লিখতে হয়নি তাঁকে।

কাবিননামায় এখনো ‘কুমারী’ শব্দ থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন মহসিনুর-নাজিয়া দম্পতি। তাঁরা বলেন, এ ধরনের শব্দ নারীর জন্য অবমাননাকর, অপমানজনক।

‘কুমারী’ শব্দটি কাবিননামা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। হাইকোর্ট এই শব্দ বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। তবে এখনো কাবিননামায় এই শব্দটি রয়ে গেছে।

নারী ও পুরুষের যুগলবন্দী হওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে বাংলা পরিভাষায় ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলে। আরবিতে বলা হয় ‘নিকাহ’। বিয়ে সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আক্দ’। প্রস্তাব, গ্রহণ, সাক্ষী ও দেনমোহর হলো ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌল তিন উপকরণ। এর লিখিত রূপ হলো ‘কাবিন’।

আরও পড়ুন

১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় ২০০৯ সালে। এই বিধি অনুযায়ী, বিবাহ নিবন্ধন ফরমের পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে কনের বৈবাহিক অবস্থার বিষয়ে ‘কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি না’ উল্লেখ করা হয়। আর ফরমের ২১ অনুচ্ছেদে বরের কোনো স্ত্রী বর্তমান আছে কি না, থাকলে অন্য বিয়ের জন্য ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী সালিসি কাউন্সিলের অনুমতি নিয়েছেন কি না, তা পূরণ করতে হয়।

কাবিননামার ফরমের পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদটিকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নারীপক্ষ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি রিট করেছিল। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কাবিননামার ফরমের পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ কেন বৈষম্যমূলক ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কেন ‘কুমারী’ শব্দটি বিলোপ করে কাবিননামা সংশোধন এবং বরের বৈবাহিক অবস্থা-সম্পর্কিত কোনো ক্রমিক কাবিননামায় উল্লেখ করা হবে না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। ২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে কাবিননামায় পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে থাকা ‘কুমারী’ শব্দটি সংবিধান পরিপন্থী এবং তা বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

রায়ে বলা হয়, কাবিননামায় ‘কুমারী’ শব্দ থাকা নারীর জন্য অপমানজনক, বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট এবং সংবিধান ও সিডও সনদের (বৈষম্য বিলোপ সনদ) পরিপন্থী। এখানে লিখতে হবে কন্যা অবিবাহিত, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত নারী কি না। নিকাহনামার ২১ নম্বর দফা সংশোধন করে সেখানে অনুরূপভাবে লিখতে হবে, বর বিবাহিত/অবিবাহিত/তালাকপ্রাপ্ত/বিপত্নীক কি না। ছয় মাসের মধ্যে কাবিননামার ফরম সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

তবে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, এখনো কাবিননামায় সংশোধনী আসেনি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের লিগ্যাল স্পেশালিস্ট (জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট) আয়েশা আক্তার বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের পর প্রায় চার বছর পার হয়েছে। কিন্তু রায়ের আলোকে কাবিননামার ফরমে এখন পর্যন্ত কোনো সংশোধনী আনা হয়নি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ সংবেদনশীলতা ও জবাবদিহির অভাবে ফরমে সংশোধনী আসেনি। সংক্ষুব্ধ হয়ে ব্লাস্ট, নারীপক্ষ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যৌথভাবে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিবাদীদের প্রতি একটি নোটিশ পাঠায়।

ফরমের খসড়া করেছে পিবিআই

গত ৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর নিকাহনামার ফরম সংশোধনবিষয়ক একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, ফরমের খসড়া প্রস্তুত করেছে পিবিআই।

খসড়া ফরমটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে পিবিআই সূত্রে জানা যায়। খসড়া ফরমে কনে অবিবাহিত, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত কি না; বর বিবাহিত, অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত, বিপত্নীক কি না এবং স্ত্রী থাকলে কয়জন আছে, এই স্ত্রীদের তথ্য জানানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আইনসচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে সই করেছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের অনেকে আবার বিয়ে করার সময় তালাকের তথ্য গোপন করে ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘কুমারী’ লেখেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে তালাকপ্রাপ্ত নারী যখন আবার বিয়ে করেন, তখন উভয় পক্ষের সম্মতিতে তিনি ‘কুমারী’ উল্লেখ করে নিকাহনামা ফরম পূরণ করেন। তবে বিয়ের পর কোনো বিরোধ হলে নিকাহনামায় ‘কুমারী’ লেখায় বরপক্ষ কনের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা করে। এসব ক্ষেত্রে নারীরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হন। তা ছাড়া সম্প্রতি বহুবিবাহের বিভিন্ন ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা রোধে নিকাহনামার ২১ অনুচ্ছেদে বরের একাধিক বিয়ে থাকলে কটি বিয়ে, তা যাতে উল্লেখ করা হয়, তার ব্যবস্থা খসড়া ফরমে রাখা হয়েছে।

গতকাল বুধবার পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে একটি মামলার প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, মামলাটি করেছিলেন সমাজের একজন নামকরা ব্যক্তি। বর-কনে দুজনই তালাকপ্রাপ্ত ছিলেন। উভয় পক্ষের সম্মতিতেই বিয়ের সময় কনে ‘কুমারী’ লিখেছিলেন। পরে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বরপক্ষ মামলা করে। পিবিআই মামলাটি তদন্ত করে। তদন্তে দুই পক্ষের সম্মতিতেই কনে ‘কুমারী’ লিখেছিলেন বলে উঠে আসে। তদন্ত শেষে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আদালত তা গ্রহণ করেন। মামলাটি খারিজ করে দেন। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু ঘটে চলছে।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এমন সব মামলার অভিজ্ঞতা এবং আদালতের রায় জানার পর তাঁরা খসড়া ফরম প্রস্তুতের উদ্যোগটি নেন। পরে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন।

বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিসের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইন মন্ত্রণালয় থেকে নিকাহনামার নতুন সংশোধনী ফরম ছাপানোর জন্য এখনো কোনো নির্দেশনা তাঁরা পাননি। নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নির্দিষ্ট প্রেসকে ছাপানোর জন্য চিঠি পাঠানো হবে।