শাস্তি কমছে, জামিনের সুযোগও বাড়ছে

সব মিলিয়ে বিদ্যমান আইনের অন্তত ১২টি ধারায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। দুটি ধারা অজামিনযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। 

সড়ক দুর্ঘটনা
প্রতীকী ছবি

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মুখে করা সড়ক পরিবহন আইন দুর্বল হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনের অন্তত ১২টি ধারা পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে দুটি ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য হয়ে যাবে। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরাধের দায়ে যে সাজা ও জরিমানার বিধান রয়েছে, তা–ও কমবে। 

গতকাল বুধবার ‘সড়ক পরিবহন (সংশোধন) আইন ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের খসড়াটির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় মন্ত্রিসভার বৈঠক। পরে বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদের সচিব মো. মাহবুব হোসেন। তিনি প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। 

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সড়কে শৃঙ্খলা আনতে একটি কঠোর আইনের দাবি দীর্ঘদিনের। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। তবে পরের বছর নভেম্বরে আইনটি কার্যকর করতে গিয়ে পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে সরকার। তখন পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কিছু ধারা প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত হয়। আইনটি সংশোধনের আশ্বাসের পর আন্দোলন বন্ধ হয়। 

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের জন্য ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি গঠন করা হয়। তাঁদের কাছে আইনের ২৯টি ধারা সংশোধনের দাবি করেছিল পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এর মধ্যে ১০৫, ৮৪ ও ৯৮ ধারাও ছিল। 

সড়ক পরিবহন আইনের সবচেয়ে কঠোর ধারা হচ্ছে ৮৪, ৯৮ ও ১০৫। এগুলো অজামিনযোগ্য অপরাধ। প্রস্তাবিত আইনে ৮৪ ও ৯৮ ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। 

এর মধ্যে ৯৮ ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মোটরযান চালানোর ফলে দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের দণ্ডের কথা আছে। এখন এই ধারায় নতুন করে মোটরযানের মালিককে বিমা করতে বলা হয়েছে। আর নির্ধারিত কোনো মোটরযানের কারিগরি নির্দেশ অমান্যের দণ্ডের কথা আছে ৮৪ ধারায়। 

তবে, ১০৫ ধারা এখনকার মতো অজামিনযোগ্য থাকছে। দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির কথা আছে এই ধারায়। এতে বলা আছে, এই আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা তাঁর প্রাণহানি ঘটলে, সে-সংক্রান্ত অপরাধগুলো দণ্ডবিধিতে থাকা বিধান অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে শর্ত হিসেবে বলা আছে, দণ্ডবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতরভাবে আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের জন্য ২০১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের সমন্বয়ে একটি গঠন করা হয়। তাঁদের কাছে আইনের ২৯টি ধারা সংশোধনের দাবি করেছিল পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এর মধ্যে ১০৫, ৮৪ ও ৯৮ ধারাও ছিল। 

পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনের বিচার সম্পন্ন হতে অনেক সময় লাগে। অনেক সময় কিছু দিন চলার পর মামলা আর এগোয় না। জামিনযোগ্য ধারা বহাল থাকলে দায়ী ব্যক্তিদের কারাগারে থাকতে হবে না। সহজেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। তাই অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। 

প্রস্তাবিত আইনে আলাদা করে বলা হয়েছে, যদি ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন না করেন অথবা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেন, তাহলে এই শাস্তি হবে। 

আইনে আরও পরিবর্তন

কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত, প্রত্যাহার বা বাতিল করা হলে তিনি কোনো মোটরযান চালাতে পারবেন না। এটি লঙ্ঘনের জন্য এখন শাস্তি আছে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়ায় জরিমানা কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। 

৬৯ ধারায়ও সাজা কমানো হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ব্যতীত ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত, প্রদান বা নবায়নে বিধিনিষেধ রয়েছে। বর্তমানে এই ধারা লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর, তবে কমপক্ষে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। সেটি কমিয়ে এখন সাজার মেয়াদ দুই বছর রাখা হলেও অর্থদণ্ড কমিয়ে তিন লাখ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

আইনের বিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কন্ডাক্টরের লাইসেন্স ছাড়া কোনো গণপরিবহনে এই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি তা করেন, তাহলে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। প্রস্তাবিত আইনে এখানে সাজা ঠিক রাখা হলেও কন্ডাক্টরের সঙ্গে সুপারভাইজারের কথাও যুক্ত করা হয়েছে। 

বিদ্যমান আইনে গণপরিবহনে ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন না করলে ও নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করলে সর্বোচ্চ ১ মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রয়েছে। এ ছাড়া চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষ সূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে। প্রস্তাবিত আইনে শাস্তি কমেনি। তবে বর্তমানে দুটি অপরাধ একসঙ্গে করলে শাস্তি হয়। প্রস্তাবিত আইনে আলাদা করে বলা হয়েছে, যদি ভাড়ার তালিকা প্রদর্শন না করেন অথবা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেন, তাহলে এই শাস্তি হবে। 

বর্তমানে মিটারে জালিয়াতির জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে। প্রস্তাবিত আইনে সেটি কমিয়ে তিন মাসের কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার কথা বলা হয়েছে। 

অতিরিক্ত ওজন বহন করে মোটরযান চালানোর সাজাও কমানো হয়েছে। টার্মিনাল উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং চাঁদাবাজির শাস্তি হবে দণ্ডবিধি অনুযায়ী। 

বিদ্যমান আইনে ট্রাফিক চিহ্ন ও সংকেত লঙ্ঘন করলে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হবে। এ ছাড়া চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কাটার কথা রয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে জরিমানা কমিয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। 

আগের আইনের তুলনায় বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনে জরিমানার পরিমাণ বহুগুণ বাড়ানো হয়েছিল। আইনটি প্রণয়নে যুক্তদের যুক্তি ছিল, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে চালক–মালিকেরা আইন মানতে বাধ্য হবেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর লক্ষ্য ছিল জরিমানা কমানো। 

সাধারণত পুলিশ বা ভ্রাম্যমাণ আদালত রাস্তায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জরিমানা আরোপ করেন। কারাদণ্ড দেন খুব কম। জরিমানা কমালে তা পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের পক্ষেই যাবে।